পলাতক আসামিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না : আসিফ নজরুল

প্রার্থীদের দেশি-বিদেশি আয়ের উৎস ইসিতে দিতে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ, বন্ধ হলো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ, ফিরলো ‘না ভোট’ :: শ্রম আইন সংশোধন ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ চূড়ান্ত, ৩টি নীতিগতভাবে অনুমোদন :: জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন।

অনলাইন ডেস্ক : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের দেশি-বিদেশি আয়ের উৎস, সম্পত্তি, বিবরণ নির্বাচন কমিশনে দিতে হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন। পোস্টাল ভোটিংয়ের বিধান চালু, একক প্রার্থীর আসনে না ভোট, জামানত ৫০ হাজার টাকা, অনিয়মে পুরো আসনের ভোট বাতিলের বিধানসহ এক গুচ্ছ প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে সংশোধিত অধ্যাদেশে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) আইন পাসের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। এতে পলাতক ব্যক্তিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকলে সেখানকার ভোটারদের না ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকছে। ভোটাররা ওই একক প্রার্থীকে পছন্দ না করলে না ভোট দিয়ে অনাস্থা জানাতে পারবেন। আগের সরকারের আমলের নির্বাচনের মতো কেউ যেন একক প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হতে না পারেন সেজন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-২০২৫-এ এমন বিধান রাখা হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ আইনের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আইনের সংশোধিত অধ্যাদেশে ইভিএম সংক্রান্ত বিধান বিলুপ্ত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রার্থীর যোগ্যতা অযোগ্যতায় পলাতক ব্যক্তিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, পলাতক ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, সংশোধিত অধ্যাদেশে এটা যুক্ত করা হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আদালত যখন পলাতক ঘোষণা করে তাদের অযোগ্য করা হয়েছে। যেদিন আদালত আপনাকে আসতে বলছে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, আসছেন না, তখন আদালত পলাতক ঘোষণা করেন। বিচার চলাকালীন সময়েও পলাতক হয়। প্রার্থীদের হলফনামায় এফিডেভিটের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি আয়ের উৎসের বিবরণ দেওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন, প্রার্থীদের দেশি-বিদেশি আয়ের উৎস, সম্পত্তি, বিবরণ নির্বাচন কমিশনে দিতে হবে। এটা আমরা ওয়েবসাইটে পাবলিক করে দেব, এতে সবাই জানবে কার কি সম্পত্তি। এবার ভোটে প্রার্থীদের জামানত বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা এবং একক প্রার্থীর আসনে ‘না’ ভোটের বিধান করা হয়েছে।

গত ২০১৪ সালের প্রসঙ্গ টেনে উপদেষ্টা বলেন, না ভোটের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। একজন প্রার্থী থাকলে সেখানে না ভোট হবে। ২০১৪ সালের ভুয়া সাজানো নির্বাচন যেন না হয় সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। জোটভুক্ত হলেও প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান যুক্ত করা হয়েছে সংশোধিত আরপিওতে। ভোটের সময় অনেকে জোটভুক্ত হলে জনপ্রিয় বা বড় দলের প্রতীকে ভোট করা যেত। এখন আর সে সুযোগ থাকছে না। উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনী জোট হলে, জোটের অংশ হলেও দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে। যাতে ভোটাররা ক্লিয়ার আইডিয়া পায় উনি কোন দলের। নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি, প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য পোস্টাল ব্যালট ভোটের বিধানটি আরপিওতে যুক্ত করা হয়েছে। এবার আইটি-সাপোর্টেড পোস্টাল ভোটিং চালু করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটারদের পাশাপাশি কারা হেফাজতে থাকা ব্যক্তি, সরকারি কর্মকর্তা, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারাও ভোট দিতে পারবে। ভোট গণনার সময় সাংবাদিকদের উপস্থিতি থাকার বিধানটিও যুক্ত করা হয়েছে বলে জানান আইন উপদেষ্টা। রাজনৈতিক দলের অনুদানের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। যিনি অনুদান দেবেন তার ট্যাক্স রিটার্নও দিতে হবে। অনিয়ম বন্ধে প্রয়োজনে নির্বাচনী আসন স্থগিতের বিধান যুক্ত করা হয়েছে সংশোধিত অধ্যাদেশে। আসিফ নজরুল বলেন, আগের আইনে বিধান ছিল কোনো ভোটকেন্দ্রে গ-গোল হলে কেন্দ্রে ফলাফল বাতিলের। এখন ইসি যদি মনে করে একটি নির্বাচনী এলাকাতেই এতো অনিয়ম হয়েছে, পুরো এলাকার ভোট বাতিল করা উচিত, তাহলে সেটি করতে পারবে। সে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। জোটবদ্ধ নির্বাচন করলেও প্রার্থীদের নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। ভোটাররা যাতে পরিষ্কার ধারণা পান, প্রার্থী কোন দলের-এজন্য এই বিধান করা হয়েছে। উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, প্রবাসীরা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারবেন। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রিসাইডিং অফিসার, রিটার্নিং অফিসারসহ নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্তদের জন্য পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। সংশোধিত আরপিওতে ভোট গণনার স্থানে মিডিয়া থাকতে পারবে-এমন বিধান রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক দলকে চাঁদা বা অনুদান হিসেবে ৫০ হাজার টাকা বা তার বেশি টাকা দিলে তা ব্যাংকিং চ্যানেলে দেওয়ার বিধান করা হয়েছে। যিনি চাঁদা দেবেন, তার ট্যাক্স রিটার্নও জমা দিতে হবে। আগে ভোটকেন্দ্রে গ-গোল হলে নির্বাচন কমিশন সেই কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করতে পারত- সেই বিধান ছিল। এখন অনিয়মের কারণে নির্বাচন কমিশন চাইলে পুরো নির্বাচনী এলাকার ভোটই বাতিল করতে পারবে-সেই বিধান করা হয়েছে।

কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির অপরাধে শ্রম আইনে কঠোর বিধান
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, উপদেষ্টা পরিষদে শ্রম আইন সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুমোদন হয়েছে। এখানে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আইনের ৯০টি সেকশনে এবং তিনটি সিডিউলে সংশোধন আনা হয়। এই সংশোধনগুলো আনা হয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার যে কমিটি আছে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী। আসিফ নজরুল বলেন, সংশোধিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী এখন থেকে শ্রম আইন অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। শ্রমিকের সংজ্ঞা বর্ধিত করা হয়েছে, গৃহপরিচারক এবং নাবিকদের ক্ষেত্রে। তারাও এখন শ্রমিক হিসেবে আইনের সুরক্ষা পাবেন। কালো তালিকাভুক্ত করার একটা সুযোগ ছিল, যাদের বিরুদ্ধে মালিপক্ষের অভিযোগ থাকতো তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হতো। তারা অন্য কোথাও চাকরি পেতো না। সেটিকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। কঠোর বিধান করা হয়েছে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে। অন্তঃসত্ত্বা যারা আছেন, তাদের কল্যাণ সুবিধা অনেক বাড়ানো হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং রেজিস্ট্রেশন অনেক সহজ করা হয়েছে। আসিফ নজরুল বলেন, বেতন নিয়ে একটা বৈষম্য ছিল। ছেলেদের একই কাজ মেয়েরা করলে কম বেতন দেওয়া হতো। সেই বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান শক্তিশালী করা হয়েছে। কর্মস্থলে দুর্ঘটনা হলে সেটার জন্য একটা ফান্ড প্রস্তুত করার কথা বলা হয়েছে; যারা দুর্ঘটনার শিকার হবেন তাদের পুনর্বাসন এবং চিকিৎসার জন্য।

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে দুইটি আইন চূড়ান্তভাবে অনুমোদন ও তিনটি আইন নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। আর দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, জুলাই স্মৃতি জাদুঘর আইন ও সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আইনের ব্যাপারে নীতিগত অনুমোদন করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, আজকে আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুইটা আইন পাস হয়েছে। আর তিনটা আইনের নীতিগত অনুমোদন হয়েছে। যে আইন গুলো পাস হয়েছে চূড়ান্তভাবে, একটা হচ্ছে বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ (বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধনী অধ্যাদেশ)। আরেকটা হচ্ছে আরপিও (জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ/ জনগণের প্রতিনিধিত্ব আদেশ), এটা নির্বাচন-সংক্রান্ত। এই দুইটা আইন পাস হয়েছে। আর তিনটা আইন নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আইন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ও জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর আইন। এই তিনটা আইন নীতিগতভাবে অনুমোদন হয়েছে। আরেকটু আমাদের আলোচনা করতে হতে পারে। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবার উপদেষ্টা পরিষদে তোলা হবে। ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।ই

মন্তব্য করুন