নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস আজ : প্রসবকালীন অবহেলায় বাড়ছে মাতৃমৃত্যু

নিজস্ব প্রতিনিধি : চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি হন ২২ বছরের রুখসানা বেগম। গর্ভাবস্থার প্রথম ৬ মাস একবারও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হননি তিনি। হঠাৎ একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যান। বাধ্য হয়ে স্বজনরা নিয়ে আসেন হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে উচ্চ রক্তচাপ। যা সময়মতো চিকিৎসা না পেলে মা ও সন্তানের ২জনের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।

গাইনি বিশেষজ্ঞরা জানান, যদি রুখসানার গর্ভাবস্থায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হতো, এ বিপদ এড়ানো সম্ভব ছিল। রুখসানার গল্প শুধু একার নয়। তার মতো জটিলতায় মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছেন অসংখ্য মা। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন ১৯ জন। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮৩ এবং ২০২৩ সালে ৭৫ জন।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মৃত্যুর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, একলামশিয়া (খিঁচুনি), সংক্রমণ এবং জরায়ু ফেটে যাওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতা।

চমেক হাসপাতালের প্রসূতি রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. ফাহমিদা ইসলাম চৌধুরী বলেন, হাসপাতালে আসা বেশিরভাগ ডেলিভারি রোগীই নানা জটিলতা নিয়ে ভর্তি হন। অনেকেই শেষ মুহূর্তে আসেন। তখন অনেক সময় কিছুই করার থাকে না।

গর্ভাবস্থার শুরু থেকেই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার ওপর জোর দিয়ে বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসকরা জানান, নিয়ম অনুযায়ী গর্ভকালীন অন্তত চারবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা জরুরি। প্রথমবার ১৬ সপ্তাহে, দ্বিতীয়বার ২৪-২৮ সপ্তাহে, তৃতীয়বার ৩২ সপ্তাহে এবং শেষবার ৩৬ সপ্তাহে। তবে অধিকাংশ নারী এসব নিয়ম মানেন না। অনেকে একবারও আসেন না, কেউ আসেন একেবারে শেষ সময়ে। তখন গর্ভের শিশুর অবস্থাও জটিল হয়ে যায়, মায়েরও। ফলে বাধ্য হয়ে অস্ত্রোপচারের আশ্রয় নিতে হয়। এই সময়ে জটিলতা বেড়ে অনেক সময় প্রাণহানিও ঘটে।

অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি অধ্যাপক ডা. কামরুন নেসা রুনা বলেন, গর্ভধারণ কোনো অসুস্থতা নয় এবং সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু কাম্য নয়। প্রধান মৃত্যুর কারণ হলো প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং একলামশিয়া, যা প্রায় ৫৫ শতাংশ প্রসূতি মৃত্যুর জন্য দায়ী।

এদিকে, চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে জেলার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৫৪ হাজার ৫৮৬টি শিশুর জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হয়েছে ২৬ হাজার ৫১৭টি শিশুর। যা মোট জন্মের ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

একই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বেসরকারি হাসপাতালে সিজারের হার বেশি। সেখানকার সিজারের হার ৬১ দশমিক ৯৪ শতাংশ, আর সরকারি হাসপাতালে ৩৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। তবে স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতাল এগিয়ে। এই সময়ে ২৮ হাজার ৬৯টি স্বাভাবিক প্রসবের মধ্যে ১৬ হাজার ৮৮৫টি হয়েছে সরকারি হাসপাতালে এবং ১১ হাজার ১৮৪টি বেসরকারি হাসপাতালে।

নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস আজ : আজ ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘মাতৃস্বাস্থ্যসেবায় সমতা, কোন মাকে পেছনে না রেখে।’ ১৯৯৭ সাল থেকে নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমুত্যু কমানো ও নবজাতকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মে মাসের ২৮ তারিখকে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। যার মূল উদ্দেশ্য নিরাপদ মাতৃত্বকে নারীর অধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা।

সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করা হবে দিবসটি। সরকারি-বেসরকারি এবং বিভিন্ন সংস্থা দিবসটি নিয়ে নানা আয়োজন করেছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, গাইনি চিকিৎসকদের সংগঠন ওজিএসবিএস এবং মমতাসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।পূ

মন্তব্য করুন