তরিক বাহিনী’র সন্ত্রাসী তাণ্ডবে অশান্ত রাজশাহী

হত্যাচেষ্টা-মাদক-অস্ত্র ব্যবসা-চাঁদাবাজি :
স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা টিটুর মদদে বেপরোয়া বাহিনীর সদস্যরা * প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, হামলার শিকার ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতারাও
খবর ডেস্ক :
‘তরিক বাহিনী’র সন্ত্রাসী তাণ্ডবে অশান্ত রাজশাহী
অশান্ত হয়ে উঠেছে শান্তির নগরী রাজশাহী। এখানে বেপারোয়া উত্থান ঘটেছে ‘তরিক বাহিনী’র। তরিক ও তার ভাই আদরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই গ্যাং হত্যাচেষ্টা, মাদক ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবসা, ছিনতাই, নির্মাণাধীন ভবন ও ফুটপাতে চাঁদাবাজি এবং বালুমহল দখলসহ নিয়ন্ত্রণ করছে রাজশাহীর অপরাধ জগৎ।

এই বাহিনীর প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে বিভিন্ন অপরাধে ১০ থেকে ১৫টি মামলা। শুধু তরিকের বিরুদ্ধেই মামলা রয়েছে ১৫টি। এই বাহিনীর রয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের বড় সংগ্রহ। তরিক ও তার বাহিনীর সদস্যরা আগ্নেয়াস্ত্রসহ বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু তারপরেও থামেনি তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।

অভিযোগ রয়েছে, রাজশাহী মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক টিটুর প্রত্যক্ষ মদদে এতটা বেপরোয়া হয়েছে এই বাহিনী। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে টিটু এই বাহিনীকে ব্যবহার করছেন বলেও অভিযোগ।

তরিক এবং তার বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত টিটু নগরীর বিভিন্ন স্থানে আড্ডা দেন। তরিকের সঙ্গে টিটুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের এসব ছবি ফেসবুকে প্রায়শই পোস্ট করা হয়। তরিক ও তার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে করা মামলার তালিকা (পিসিআর) এবং প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়ার ভিডিও যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত আছে।

তরিক বাহিনীর নৃশংস হামলায় ইতোমধ্যে রিগ্যান, মানিক, সুজন, রবিনসহ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জিম্মি বালিয়াপুকুর, টিকাপাড়া, তালাইমারি, ভদ্রা, মেহেরচণ্ডিসহ নগরীর বিস্তৃত এলাকা। এসব এলাকায় তরিক বাহিনীর তাণ্ডব আর নৃশংসতায় অসহায় সাধারণ মানুষ। ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েও কেউ ভয়ে মুখ খোলার সাহস পান না।

স্থানীয়রা জানান, নগরীর বালিয়াপুকুর এলাকার বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম তরিক এবং তার ভাই তহিদুল ইসলাম আদর কিশোর বয়স থেকেই মাদকাসক্ত। তারা শৈশব থেকেই ছিনতাই ও ছিঁচকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। নগরীর পদ্মা আবাসিক এলাকা, ভদ্রা মোড়, তালাইমারি মোড়, মুন্নাফের মোড়, বালিয়াপুকুরসহ আশপাশের এলাকায় ছিনতাকারী চক্র গড়ে ওঠে। তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল দুই ভাই তরিক ও আদর।

তরিক এক সময় ছাত্রদল কর্মী ছিলেন। ২০১৩ সালে তরিক গ্রেফতার হলে তার মুক্তির দাবিতে ছাত্রদলের উদ্যোগে পোস্টারও সাঁটানো হয়। পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এলে জার্সি বদল করেন তরিক। ছাত্রলীগে ভেড়েন তিনি। মতিহার এলাকার ছাত্রলীগ কর্মী ফয়সালের আশ্রয়ে তরিক দলে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

ছোট ভাই আদর, লালন, সনেট, ফয়সাল, আরিফ, উজ্জ্বল, রুবেল, ফাহিম, শাকিল, মনির, ইমন ও পলাশকে নিয়ে গড়ে তোলেন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনী। সর্বশেষ স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা টিটুর বিশেষ সুপারিশে মহানগর ছাত্রলীগের সিয়াম-সবুজ কমিটিতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদকের পদ পান তরিক। ছাত্রলীগের পদ পেয়ে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সান্ধ্যকোর্স বিরোধী আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই ঘটনায় ছাত্রলীগের ভাড়াটিয়া হিসাবে হামলায় অংশ নিয়ে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে আলোচনায় আসেন তরিক।

এ ঘটনায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। গুলিবিদ্ধ হন অনেকেই। এ ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় হয়। জাতীয় সংসদেও এ নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়। ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি নগরীর মহিষবাথান থেকে ডিবি পুলিশের অভিযানে পিস্তুল, ৬ রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগাজিনসহ গ্রেফতার হন তরিক।

২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার সময় ভদ্রা এলাকায় মহানগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি মেহেদী হাসান রিমেল ওরফে রিগ্যানকে ছুরিকাঘাত করেন তরিক। ১৯ আগস্ট তরিককে ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়।

২৩ নভেম্বর রাতে নগরীর বালিয়াপুকুর এলাকায় ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কার্যালয়ে কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান মনিরকে লক্ষ্য করে গুলি করেন তরিক। গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আওয়ামী লীগ কর্মী একরামুল হক ওরফে গুড্ডুর পায়ে লাগে। গুড্ডুর অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় সেদিনই তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। এ ঘটনায় গুড্ডুর ছোট ভাই আকতারুল ইসলাম বোয়ালিয়া থানায় তরিক ও তার বাহিনীর ১৭ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার এজাহারভুক্ত চার আসামি গ্রেফতার হয়েছে। তবে তরিক এবং অন্যরা পলাতক রয়েছেন।

কাউন্সিলর মনি বলেন, তরিক, সনেট, আদর ও ফয়সাল দলবল নিয়ে এসে আমাকে গালাগাল শুরু করে। এ সময় তরিক আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করে। শতাধিক মানুষের সামনে তারা আগ্নেয়াস্ত্র এবং ধারালো অস্ত্র প্রদর্শন করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এরা এলাকায় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হিসাবে পরিচিত।

১৫ সেপ্টেম্বর তরিক বাহিনীর ক্যাডাররা রাজশাহী মহানগর যুবলীগের জনশক্তি ও কর্মসংস্থানবিষয়ক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মানিকের ওপর হামলা চালায়। তরিক এবং তার সহযোগী শাকিল রিভলভার বের করে ঘটনাস্থলে কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে ভীতির সঞ্চার করে। তরিকের অন্য দুই সহযোগী আশিক এবং সনেট মানিকের পেটে ছুরিকাঘাত করে। সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মহানগর যুবলীগের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের (পশ্চিম) সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান সুজনের ওপর হামলা চালায় তরিক বাহিনী। এ সময় সুজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায় তারা। সুজন বলেন, আমার কোমরে গভীর আঘাতের কারণে দুটি কিডনিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমি হাসপাতালে এক মাস চিকিৎসাধীন ছিলাম। কোনো রকমে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি।

একই ওয়ার্ডের যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জামিল আখতার রবিনকে তুলে নিয়ে কোপায় তরিক বাহিনী। দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন রবিন। ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর নগরীর ফুলতলায় বালুঘাট দখলকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি হয়। তরিক ও তার বাহিনী আব্দুস সাত্তার নামে এক ব্যক্তির পক্ষে ভাড়াটিয়া হিসাবে সেখানে গুলিবর্ষণ করে।

এসময় দুজন গুলিবিদ্ধ হন। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হন আরও ১০ জন। ২০১৫ সালের ২৮ মে নগরীর রানীবাজার এলাকায় ছাত্রলীগের দুপক্ষের বন্ধুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন যুবদলকর্মী জীবন শেখ (২৫)। আহত হন কমপক্ষে ১০ জন। সেখানেও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী তরিক এবং তার ক্যাডাররা একপক্ষের হয়ে বন্দুকযুদ্ধে অংশ নেন। তবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহলের হস্তক্ষেপে বিষয়টি আপস হয়ে যায়। চাপা পড়ে যায় তরিকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।

তরিক বাহিনীর সদস্যদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) হেমায়েতুল ইসলাম বলেন, তরিক এবং তার বাহিনী সম্পর্কে পুলিশের কাছে সব তথ্য রয়েছে। তারা তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তাদের গ্রেফতারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে। তবে তরিক ও বাহিনীর সদস্যরা পলাতক রয়েছেন। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।

অভিযোগ অস্বীকার করে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আব্দুল ওয়াহেদ খান টিটু বলেন, তরিক এবং তার বাহিনীকে মদদ এবং আশ্রয়-প্রশয় দেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। তরিক ছাত্রলীগের একটি পদে ছিলেন, তাই তার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। আমার কারণে ছাত্রলীগে পদ পাওয়ার অভিযোগও ভিত্তিহীন।

তরিক ও তার বাহিনীর সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, কাকতালীয়ভাবে হয়তো তাদের সঙ্গে দেখা হয়। আমার কাছে ভালো এবং খারাপ মানুষ সবাই আসেন। আমি রাজনীতি করি। তাই কাউকে এড়িয়ে যেতে পারি না।

মন্তব্য করুন