ছোটদের সাথে নবীজীর আচরণ

খবর অনলাইন :
আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজ যারা শিশু সময়ের পরিক্রমায় কাল তারাই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধার হবে। দেশ ও জাতির দায়িত্বভার গ্রহণ করবে ও নেতৃত্ব দেবে। তাই শিশুদের মন, মনন ও মানস গঠনে তাদের সাথে কেবল এমন আচরণই করা উচিত যা তাদের চরিত্রবান মানুষ ও আদর্শ নাগরিকরূপে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে। কেননা, আজকের শিশু-কিশোরদের সাথে যেমন আচরণ করা হবে ও তাদেরকে যে শিক্ষা দেয়া হবে সে অনুযায়ীই তারা বেড়ে উঠবে। তাই ছোটদের সাথে কেবল এমন আচরণই করা কাম্য ও তাদের শুধু এমন শিক্ষাই দেয়া উচিত যার দিয়ে তারা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। শিশু-কিশোরদের সাথে আচরণ কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয় ও তাদের শিক্ষা-দীক্ষা কেমন হওয়া উচিত তার স্পষ্ট নির্দেশনা মহানবী সা:-এর কর্ম ও উক্তিসমূহে বিদ্যমান। বক্ষ্যমান নিবন্ধে আমরা ছোটদের সাথে আচরণের নববী আদর্শের কিছু নমুনা পেশ করছি।

আল্লাহর বিধান মানার নির্দেশ : শিশু-কিশোরদের প্রথমেই শেখাতে হবে আল্লাহ তায়ালা এক ও অদ্বিতীয়। তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তিনিই সৃষ্টি করেছেন। মানব, দানব ও সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা তিনিই। তার শক্তি ও সামর্থ্য সীমাহীন। তার মতো ক্ষমতা আর কারো নেই। তিনি কারো উপকার করতে চাইলে কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। আর কারো ক্ষতি করতে চাইলে কেউ তার উপকার করতে পারে না। ভালো-মন্দ সব তারই পক্ষ থেকে হয়। তাই ইহ ও পরকালে রক্ষা পেতে চাইলে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালার সব বিধান মেনে চলতে হবে। তার আদেশ-নিষেধ মান্য করতে হবে। এ জন্য বিশ্বনবী সা: শিশুদেরকে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার নির্দেশ দিতেন। হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, কোনো এক সময় আমি রাসূলুল্লাহ সা:-এর পেছনে ছিলাম। তিনি বললেন, ‘হে তরুণ! আমি তোমাকে কয়েকটি কথা শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি আল্লাহ তায়ালার বিধি-নিষেধ রক্ষা করবে, আল্লাহ তায়ালাও তোমাকে রক্ষা করবেন। তুমি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির প্রতি লক্ষ রাখবে, এতে আল্লাহ তায়ালাকে কাছে পাবে। তোমার কোনো কিছু চাওয়ার প্রয়োজন হলে আল্লাহ তায়ালার কাছে চাইবে। আর সাহায্য প্রার্থনা করতে হলে আল্লাহর কাছেই করবে। জেনে রেখো, যদি সব উম্মতও তোমার কোনো উপকারের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে ততটুকু উপকারই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। অপরদিকে, যদি সব উম্মত তোমার কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে একতাবদ্ধ হয়, তাহলে ততটুকু ক্ষতিই করতে সক্ষম হবে যতটুকু আল্লাহ তায়ালা তোমার ভাগ্যে লিখে রেখেছেন। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং লিখিত কাগজসমূহও শুকিয়ে গেছে।’ (সুনানে তিরমিজি-২৫১৬)

নামাজ আদায় করার নির্দেশ : প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য নামাজ আদায় করা ফরজ নয়। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই যদি ছেলেমেয়েদের নামাজ শেখানো না হয় ও আদায় করার নির্দেশ না দেয়া হয়, তাহলে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও তারা নামাজ আদায় করতে সক্ষম হবে না, ফলে ফরজ হওয়ার পর বহু নামাজ ছুটে যাওয়া ও কাজা হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই মা-বাবা, শিক্ষক ও অভিভাবকদের দায়িত্ব হলো- প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই ছেলেমেয়েদের নামাজ শেখানো ও তা আদায় করার নির্দেশ দেয়া। ছেলেমেয়েদের বয়স সাত বছর হলেই মহানবী সা: তাদেরকে নামাজ আদায় করতে আদেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আমর ইবনে শুয়াইব বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছর হলে তাদেরকে নামাজ আদায়ের নির্দেশ দাও। যখন তাদের বয়স ১০ বছর হয়ে যাবে তখন আদায় না করলে তাদের শাস্তি দেবে ও তাদের ঘুমের বিছানা আলাদা করে দেবে।’ (সুনানে আবু দাউদ-৪৯৫)

সালাম দেয়ার নির্দেশ : আরবি সালাম শব্দের অর্থ হলো শান্তি। ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ’ বলে যে সালাম দেয়া হয় তার অর্থ হলো- ‘আপনার উপর শান্তি ও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক’ সালামের অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে প্রতীয়মান হয়, বাক্যটি শ্রদ্ধাজ্ঞাপক ও দোয়ামূলক। অতএব, যেসব লোককে সালাম দেয়া হয় প্রকারান্তরে তাদেরকে শ্রদ্ধা করা হয় ও তাদের জন্য কল্যাণের দোয়া করা হয়। আর শ্রদ্ধা ও কল্যাণের দোয়া পাওয়ার অধিকতর হকদার হলো আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজন। তাই মহানবী সা: শিশু-কিশোরদের তাদের পরিবার-পরিজনদের সালাম দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আনাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে বলেছেন, ‘হে বৎস! তুমি যখন তোমার পরিবার-পরিজনের কাছে যাও, তখন সালাম দিও। তাতে তোমার ও তোমার পরিবার-পরিজনের কল্যাণ হবে।’ (তিরমিজি-২৬৯৮)

সুন্দরভাবে খাওয়ার নির্দেশ : দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হলো খাবার খাওয়া। খাওয়া ছাড়া বেঁচে থাকা যায় না। প্রতিদিন আমরা বহুবার বিভিন্ন ধরনের খাবার খাই। এই খাবার খাওয়ার বেশ কিছু নিয়ম রয়েছে। মহানবী সা: তার উম্মতকে খাবার খাওয়ার নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন। তার শিক্ষা দেয়া খাওয়ার নিয়মগুলোর মধ্য থেকে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য হলো হালাল খাওয়া। হারাম খাওয়া ইসলামে নিষেধ।

হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, যে দেহ হারাম দিয়ে পুষ্ট হয় তা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এ জন্য আল্লাহর রাসূল সা: শিশুদেরকেও হারাম খেতে নিষেধ করতেন। বনু হাশেমের লোকদের জন্য সদকার মাল খাওয়া হারাম ছিল। একবার হজরত হাসান রা: সদকার একটি খেজুর মুখে দিলে মহানবী সা: বমির শব্দ করে তার মুখ থেকে খেজুরটি বের করে ফেলেন। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, হাসান ইবনে আলী রা: সদকার খেজুর থেকে একটি খেজুর নিয়ে তার মুখে দেন। তখন নবী করিম সা: কাখ্-কাখ্ করে বললেন, ‘তুমি কি জানো না, আমরা সদকা খাই না?’ (বুখারি-৩০৭২) পানাহারের বেশ কিছু নববী সুন্নত রয়েছে। এসব সুন্নতের কয়েকটি হলো- বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করা। ডান হাতে খাওয়া ও নিজের কাছ থেকে খাওয়া। বড়দের তো বটেই, মহানবী সা: ছোটদেরও খাওয়ার এসব নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন। হজরত উমর ইবনে আবু সালামা রা: বলেন, আমি ছোট ছেলে অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সা:-এর খেদমতে ছিলাম। খাবার বাসনে আমার হাত ছুটাছুটি করত। রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে বললেন, ‘হে বৎস! বিসমিল্লাহ বলে ডান হাতে আহার করো এবং তোমার কাছে থেকে খাও। এরপর থেকে আমি সব সময় এ নিয়মেই খাদ্য গ্রহণ করতাম।’ (বুখারি-৫৩৭৬) (চলবে)

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১

মন্তব্য করুন