
১৫ দিনের মধ্যে সীমান্ত দিয়ে পালানোর ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন আদালত
ডেস্ক : আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ‘কাউয়া কাদের’ হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। দম্ভোক্তি করে বলেছিলেন, ‘পালানো যাদের স্বভাব, তারাই পালানোর কথা বলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার আরেকটি ভাইরাল বক্তব্যÑ ‘পালাব না, প্রয়োজনে ফখরুল সাহেবের বাসায় গিয়ে উঠব।
তিন দশক আগে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোসের স্ত্রী ইমেল্দা মার্কোসের শত শত জোড়া জুতা, হাজার হাজার শাড়ির কাহিনী বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রচার পেয়েছিল। সে রকম আওয়ামী লীগ রেজিমে লুটের টাকায় ওবায়দুল কাদের দুই-তিন লাখ টাকার ঘড়ি পরতেন। লাখ লাখ টাকা দামের নানা রঙের ঘড়ি তিনি উপঢৌকন নিয়েছেন বলে প্রচার ছিল। সেই ওবায়দুল কাদেরের পালানো নিয়ে তোলপাড় চলছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালানোর পর দীর্ঘ দিন তিনি বাংলাদেশে পালিয়ে ছিলেন। অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো টের পায়নি? তিন মাস পর নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওবায়দুল কাদের এত দিন কার শেল্টারে ছিলেন, কারা টাকার বিনিময়ে তাকে ভারতে পাচার করে দিলো সে সব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্কের ঝড় উঠেছে, চলছে তোলপাড়। গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ‘গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ’ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত ওবায়দুল কাদের কীভাবে দেশ ছাড়লেন রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পুলিশ প্রধানের কাছে জানতে চেয়েছেন। ১৫ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।
গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। অবশ্য এখনো রাষ্ট্রীয়ভাবে এর সত্যতা এখনো মিলেনি। তবে এ নিয়ে দেশজুড়ে চলছে তোলপাড়। জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর গণহত্যা চালানোর অন্যতম মাস্টারমাইন্ড ওবায়দুল কাদেরের সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পলায়ন নিয়ে সর্বত্র চলছে কানাঘুষা। স্থানীয় শক্তিশালী সিন্ডিকেট ও প্রশাসনিক সহযোগিতা ছাড়া এমন দাগী আসামির পালিয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ভ‚মিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
গণমাধ্যমকর্মীরা এ ব্যাপারে বিজিবি সিলেটের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করলে জানান, তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। গত সপ্তাহে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ক্যান্টনমেন্টে যে ৬২৬ জনকে নিরাপত্তার দেয়া হয়েছিল, তারা এখন কোথায়? তাদের পালিয়ে যেতে কারা সহায়তা করল সে বিষয়টি জাতিকে জানাতে হবে।
হাসিনা পালানোর পর ময়মনসিংহ সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছেন সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু, শ্যামল দত্ত গং। পালাতে গিয়ে সিলেট সীমান্তে জনতার হাতে আটক হন সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। পালাতে গিয়ে নিহত হন সাবেক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পান্না। এছাড়া সিলেট সীমান্ত দিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম ও সাধারণ সম্পাদক ইনানসহ ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী পালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সীমান্তবর্তী ভারতের বিভিন্ন শহরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেখা মিলেছে। সিলেট সীমান্ত দিয়ে পালাতে গিয়ে দালালদের বাসা থেকে সাবেক হুইপ জান্নাত আরা হেনরিসহ কয়েকজন ধরা পড়েছেন।
সূত্রের দাবি, ওবায়দুল কাদের পতনের ৩ মাস পর প্রভাবশালীদের শেল্টারে ছিলেন। তিনি গত ৫ নভেম্বর সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি ভারতের মেঘালয় থেকে কলকাতা গেছেন বলে জানা গেছে। কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়া আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেও ৩ মাসের বেশি সময় দেশের নানা জায়গায় পালিয়ে থেকেছেন ওবায়দুল কাদের।
জানা গেছে, হাসিনা পালানোর পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ওবায়দুল কাদেরকে আটকের অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রায় দুই শতাধিক মামলার আসামি ওবায়দুল কাদেরকে আটকের চেষ্টায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু কাদেরকে আটকের অভিযান ব্যর্থ হয়। চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রীর ভাইকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করে পরে তাকে ছেড়েও দেয়া হয়েছে। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে আটক হয়েছেন কাউয়া কাদেরের ব্যক্তিগত সহকারী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসিনা পালানোর পর দেশে আত্মগোপনে থাকা বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ নেতা ইতোমধ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যেতে সক্ষম হয়েছেন। খুবই অল্প সংখ্যক নেতা দেশে রয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা দেশ ছেড়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এত সতর্ক অবস্থানে থাকার পরও কিভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, তা নিয়ে চলছে সমালোচনা। ওবায়দুল কাদেরের নেতাদের পালিয়ে যাওয়া নিয়ে মুখরোচক নানা গল্পও শোনা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে।
সূত্রের দাবি, মূলত বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সীমান্ত অবস্থানরত কতিপয় বিএনপি নেতা, আওয়ামী সমর্থনপুষ্ট একজন বিতর্কিত আলেম ও কতিপয় দালালের সমন্বিত সিন্ডিকেট আওয়ামী লীগ নেতাদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করছে বলে অভিযোগ উঠছে। কিছু নেতার পালিয়ে যাওয়ার এসব খবরে ক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকরাও। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমকর্মীরা বিজিবি সিলেটের অতিরিক্ত পরিচালক (অপারেশন) মেজর গাজী মুহাম্মদ সালাহউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। আমিও মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি, ওবায়দুল কাদের সিলেট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়েছেন। কিন্তু এ বিষয়টির কোনো সত্যতা আমাদের কাছে নেই।
ওবায়দুল কাদেরের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ব্লগ, টুইটারে তোলপাড় চলছে। নেটিজেনদের বেশির ভাগই প্রশ্ন তুলছেন গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এত সদস্য থাকার পরও ওবায়দুল কাদের ৩ মাস কাদের শেল্টারে ছিলেন। যার শেল্টারে ছিলেন তাদের গ্রেফতার করে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা হোক। আর কারা টাকার বিনিময়ে সীমান্ত দিয়ে তাকে ভারতে পালাতে সহায়তা করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
এদিকে ওবায়দুল কাদের কীভাবে দেশ ছাড়লেন, ১৫ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বিষয়ে এ ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন আদালত।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চীফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ওবায়দুল কাদের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর বাংলাদেশে ৩ মাস ছিলেন। এরপরও তিনি কোথায়-কীভাবে ছিলেন এবং কেন তাকে গ্রেফতার করা হয়নি, তিনি কীভাবে পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করেছেন, এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে একটি ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এই ব্যাখ্যা যেন দেয়া হয় সে ব্যাপারে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন।
চীফ প্রসিকিউটর বলেন, এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একটি জাতীয় ট্রাইব্যুনাল। এটি জাতির আশা-আকাংকা বাস্তবায়নের জন্য এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজ করছে। এই ট্রাইব্যুনালের আদেশ-নির্দেশ যদি কোনো সংস্থা বা বাহিনী না মানে তাহলে ধরে নেয়া হবে তারা রাষ্ট্রের কাজে সহযোগিতা করছে না এবং আইন অনুযায়ী কাজ করছে না। যদি কেউ আদালতের নির্দেশ পাওয়ার পরও কোনো আসামিকে পালাতে সহযোগিতা করে তাহলে ধরে নিতে হবে তারা আইন অনুযায়ী কাজ করছে না। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী অগ্রসর হওয়ার সুযোগ রয়েছে।ই