উত্তরাঞ্চলে মধুর স্বাদের বাহারি নামের আম, লিচু

নিজস্ব প্রতিনিধি : উত্তরাঞ্চলে মধুর স্বাদের বাহারি নামের আম, লিচু হাতছানি দিচ্ছে ভোজন রসিক ও পর্যটকদের। আম লিচু ভালবাসেনা এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেখা ও খাওয়ার মজা উপভোগ করতে হলে উত্তরাঞ্চলে আসতেই হবে। এখন চলছে মধু ফল আম লিচুর মওসুম। দেশে পর্যটন মানেই চট্রগ্রাম, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত, পার্বত্য ৩ জেলা ও চা বাগান পরিবেষ্টিত সিলেট। এর বাইরেও যে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য রয়েছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আম মওসুমে যারা একবার রাজশাহীর আ¤্রকাননে এসে অবাক বিস্ময়ে বলেছেন পর্যটনের এ যেন আরেক পিঠ। কিলোমিটার ছাড়িয়ে দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত আম ও লিচুর বাগান। চোখ ধাঁধানো নানা জাতের আম যে কাউকে নষ্টালজিয়ায় ফেলবে। মনের অজান্তে গেয়ে উঠবেন ছেলে বেলার ছড়ার কয়েকটি লাইন ‘ঝড়ের দিনে মামার বাড়ি আম কুড়াতে সুখ। পাকা আমের মধুর রসে রঙ্গিন করি মুখ’। উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ থেকে রংপুর, দিনাজপুর পর্যন্ত আম লিচুর বাগান।
সমুদ্র পাহাড় পর্যটকদের জন্য এখন অফসিজিন। তাই বলে কি ঘরে বন্দি থাকা। চলে আসুন উত্তরাঞ্চলে আম লিচুর স্বাদের পাশপাশি বাংলার প্রাচীন ইতিহাস সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিশাল একটা অংশকে প্রতিনিধিত্ব করছে এ অঞ্চল। বাংলার প্রাচীনতম নগরীর মধ্যে অন্যতম পন্ড্রুবর্ধন যা মহাস্থানগড় নামে পরিচিত। এর পরতে পরতে দাঁড়িয়ে রয়েছে নানা কাহিনী। মীর সৈয়দ মো. সুলতান মাহী সাওয়ারের মাজার বেহুলা লক্ষীনদরের ভিটাসহ নানা স্থাপনা। বগুড়ায় আমের স্বাদ পাওয়া না গেলেও বগুড়ার দৈ এর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। রংপুরে হাড়িভাঙ্গা আম ইতোমধ্যে আম রশিকদের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। আর বাড়তি হিসেবে রয়েছে শাহ জালাল বোখারির দরগা, দোয়ারি মসজিদ ও চাপড়া পোটবিহার। দিনাজপুরের নাক ফজলিকে ছাড়িয়ে গেছে রসগোল্লার মতো বেদানার লিচুতে। সারা দেশেই বড্ড কদর এ লিচুর। রয়েছে দৃষ্টিনন্দন রামসাগর, কান্তা মন্দির আর রয়েছে সুগন্ধি কাটারিভোগ চাল। আরেকটু এগিয়ে গেলেই পঞ্চগড় সমতল ভূমিতে চায়ের বাগান আর বাংলাবান্দার কাছে গিয়ে হিমালয় পর্বত দেখার অন্যরকম অনুভূতি। নাটোরের লালপুর গুরুদাসপুর পাবনার ঈশ্বরদি লিচু উৎপাদনে এগিয়ে গেছে। সাথে বাড়তি রয়েছে নাটোরের কাচাগোল্লা আর রাজবাড়ি।
এ অঞ্চলের মানুষের বৈশিষ্ট হলো তাদের সরলতা আন্তরিকতা আর আতিথেয়তা। আছে শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পরিবেশ। পথ চলতে গিয়ে দেখবেন আমের ভারে নুইয়েছে গাছ। থোকায় থোকায় ঝুলছে আম। ইচ্ছে হবে ঝুলে থাকা আমের সাথে সেলফি তুলে পোস্ট করে দিতে। আমের বাজার দেখে অবাক হবেন। কত বাহারি নামের আম। শুধু আম নয়, আরেক ঐতিহ্য রাজশাহী সিল্ক। যার কারণে সিল্কসিটি হিসাবেও পরিচিত রয়েছে। বিশাল এই জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মৌষ্য, কৃষান, গুপ্ত, পাল, সেন, সুলতানী, মোঘল, ডাচ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীসহ বৃটিশ আমলের অসংখ্য প্রতœতাত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ ইতিহাসের বহু তথ্যর উপাত্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পর্যটনের অপার সম্ভাবনায় ভাসছে পুরো উত্তরাঞ্চল। বিশ্বের এ ঐতিহ্য বরেন্দ্র যাদুঘর, নাটোরের রাজবাড়ি, বরেন্দ্রের উঁচু নিচু লাল মাটি, পুঠিয়ায় মন্দির, সারদা পুলিশ একাডেমী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, আলতাদিঘী ঐতিহাসিক বাঘা মসজিদ, কুসম্বা মসজিদ, সোনামসজিদ যা শুধু টাকার নোটে ছবি দেখে নয় বাস্তবে এলে অন্যরকম অনুভূতি হবে।
এ অঞ্চলে ঘুমিয়ে আছেন হযরত শাহ মখদুম (রহ.) হযরত তুরকান শাহ (রহ.) আব্দুল হামিদ দানিসমান্দ, হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহসহ অসংখ্য আল্লাহর ওলি। তাদের মাজার জেয়ারতে মনে প্রশান্তি আনবে। কবর রয়েছে সম্রাট শাহজাহানের পুত্র যুবরাজ শাহ সুজা ও তার স্ত্রীর। সোনামসজিদ চত্তরে শায়িত রয়েছেন দুজন শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গির ও মেজর নাজমুল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা ডাচদের নীল ও রেশমের কুঠি রাজশাহীর পদ্মার তীরে সাক্ষী হিসাবে রয়েছে। এটি বড়কুঠি নামে পরিচিত। আ¤্রকাননে ঘেরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ মতিহার চত্বর। রয়েছে এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মা। ভরা বর্ষায় উত্তাল ঢেউ মনে করিয়ে দেয় পদ্মার ঢেউরে মোর শূন্য হৃদয় নিয়ে যারে…..। আবার শুকনো মওসুমে মরুভূমিসম বিশাল বালুচর। যারা মরুভূমি দেখেননি তারা বালুচরে হেঁটে কিছুটা অনুভব করতে পারেন। কোথাও পলিতে ফসলের আবাদ দেখে মনে করতে পারেন মরুদ্যানের কথা।
শুকনো মওসুমে পদ্মার ক্ষীন ধারায় নৌকায় ভেসে বেড়াতে মন্দ লাগবে না। অবশ্যই এখানকার মাস কালাইয়ের রুটি খেতে ভুলবেন না। আমের সাথে মজাদার খাবারের পাশপাশি প্রতœতাত্বিক নিদর্শন দেখার জন্য কয়েক বছর ধরে দেশি-বিদেশি পর্যটক আসা শুরু হলেও সংখ্যায় একেবারে কম। পর্যটক আকৃষ্ট করতেই আম বাগানের একটি অংশে গড়ে তোলা হচ্ছে ছোট ছোট রিসোর্ট, বাগানবাড়ি ও বিশ্রামাগার। পর্যটকরা এসে বাগান দেখার পাশপাশি বিশ্রামও নিতে পারেন। কাঁচা পাকা আমের স্বাদ নিয়ে কিনতেও পারেন।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থার প্রতিনিধিরা উত্তরাঞ্চলের পর্যটনের অপার সম্ভাবনার বিষয়টা তুলে ধরছেন। শুধুমাত্র প্রচারের অভাবে এ অঞ্চলের পর্যটন বিকশিত হচ্ছে না। সবাই এজন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সবার এগিয়ে আসা প্রয়োজন বলে মনে করছেন। বিদেশ থেকে পর্যটকরা এসে ফাইভ স্টার হোটেল খোঁজেন না। তারা গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়াতে চান। সাধারণ মানুষের ঘরে থাকতে চান। তাদের খাবার খেতে চান। শিশুদের সাথে খেলতে চান। যোগাযোগ নির্ভর পর্যটনের মাধ্যমেই এটি সম্ভব। কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজমের মডেল হিসাবে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেষা ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মাউলিনং নামের একটি ছোট গ্রাম পর্যটনের উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সামাজিক পর্যটনের আওতায় গ্রামটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাখ করে হাজারো পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়িই এখন একেকটি অতিথিশালা।
আম লিচু ও প্রচীন ঐতিহ্য ঘিরে এমন গ্রাম গড়ে উঠতে পারে। নতুন ধান ওঠার সময় যেমন নবান্ন উৎসব হয় তেমনি আম পাড়ার সময় একটি উৎসবের আয়োজন করতে হবে। এই উৎসব দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড় হবে। এ অঞ্চলের গম্ভীরা গান, সাঁওতালদের নাচও কম আকর্ষণীয় নয়। এসব স্থানে সারাদেশ থেকে আসার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব একটা মন্দ নয়। কক্সবাজার, চট্রগ্রাম, বান্দরবন, ঢাকা ও সিলেট থেকে সরাসরি বাস যোগাযোগ রয়েছে। আমের রাজধানী রাজশাহী অঞ্চলে ঢাকার মধ্যে রয়েছে চার জোড়া আন্তনগর ট্রেন। এরমধ্যে বনলতা সেনের নামে বিরতিহীন ট্রেন। ঢাকা থেকেও পঞ্চগড় পর্যন্ত রয়েছে বেশ কয়েকটি ট্রেন। সড়ক যোগাযোগও বেশ ভাল। প্রতিদিন আকাশ পথেও যাতায়াত রয়েছে বেশকটি বিমান।
সম্প্রতি সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে সাটেল বাস যোগেও যাত্রী অনা নেয়ার ব্যস্থা নেয়া হয়েছে। সবকিছু উপভোগ করে মনের অজান্তে গেয়ে উঠবেন-এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। সে যে আমার জন্মভূমি। আর ফিরবেন আমের মধুময় স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে।ই

মন্তব্য করুন