ঢাকা ডিসি অফিস অনিয়ম–দুর্নীতির আখড়া, ভোগান্তিতে জমির মালিকেরা

নিজস্ব প্রতিনিধি : রাজধানীর জমি সংক্রান্ত সব কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কার্যালয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই অফিস ঘিরে চলছে অসংখ্য অভিযোগ—ঘুষ, দালালি, ফাইল গায়েব, নামজারি জটিলতা থেকে শুরু করে দলিল জালিয়াতি পর্যন্ত। সাধারণ নাগরিকদের কাছে এটি যেন হয়ে উঠেছে অনিয়ম–দুর্নীতির আখড়া।

সূত্রে, সাভারের এক শিক্ষক মো. ইমরান হোসেন ২ বছর ধরে নামজারি আবেদন করেছেন। বারবার ডিসি অফিসে যাতায়াতের পরও কাজ হয়নি। “দালালেরা এসে বলে, টাকা দিলে ২ দিনে হবে, না দিলে ফাইল চিরকাল পেন্ডিং। সরকারি অফিসে নিজের ফাইলের খোঁজ নিতে গিয়ে নিজেকেই অপরাধী মনে হয়, বললেন তিনি।

এমন অভিযোগ শুধু ইমরানের নয়। টঙ্গী, কেরানীগঞ্জ, ধামরাই থেকে আসা জমির মালিকেরা জানান, ডিসি অফিসের ভেতরে ও বাইরে দালালচক্র গড়ে উঠেছে। তারা অফিসের নির্দিষ্ট কক্ষে ‘যোগাযোগ’ রাখে, ফাইল তোলার সময় বা নথি যাচাইয়ের সময় ঘুষ নেওয়ার প্রক্রিয়া চালায়।

ফাইল গায়েব, দলিল হারানো, নামজারিতে বছরের পর বছর তদন্তে জানা গেছে, ডিসি অফিসে জমির নামজারি, রেকর্ড সংশোধন ও উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকানা পরিবর্তনের আবেদন জমা পড়ার পর সেগুলো গড়পড়তা ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত ঝুলে থাকে। অনেক সময় ‘নথি হারিয়ে গেছে’ বলে নতুন আবেদন দিতে বাধ্য করা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অফিস সহকারী বলেন, “প্রতিদিন শত শত ফাইল আসে। অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রাখে, কারণ ঘুষ ছাড়া এগোয় না। ডিসি অফিসে কাজ না করিয়ে নেওয়া প্রায় অসম্ভব।”প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ডিসি অফিসের গেট ও করিডরে দেখা যায় একদল দালাল। তারা আবেদনকারীদের ঘিরে ধরে সাহায্যের প্রস্তাব দেয়। ফাইল তৈরি, নামজারি ত্বরান্বিত করা বা ‘উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ’ করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দালাল বলেন, “সব কাজ নিয়মে হয় না। নিয়মে গেলে মাসের পর মাস লাগে। আমরা শুধু কাজটা একটু দ্রুত করিয়ে দিই।”কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুষ ও অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে উঠলেও প্রশাসনিক ব্যবস্থা খুব কম নেওয়া হয়। একাধিক সূত্র জানায়, বিভিন্ন বিভাগের ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’রা দালালদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কমিশন ভাগাভাগি করেন।ঢাকা জেলা প্রশাসনের এক সাবেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “দুর্নীতির শিকড় নিচ থেকে ওপরে পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। অনেক সময় সৎ কর্মকর্তারাও চাপের মুখে পড়েন।

সরকার জমির নথি ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নিলেও ডিসি অফিসের কর্মপদ্ধতি এখনো অনেকাংশে পুরোনো। ‘e-Mutation’ সিস্টেম চালু থাকলেও অনেক আবেদন অনলাইনে করলেও শেষে গিয়ে হাতে ঘুষের টাকা ছাড়া অনুমোদন হয় না।ডিজিটাল ফাইল যাচাইয়ের নামে কর্মকর্তারা আবেদনকারীদের ডেকে নিয়ে আবারও কাগজপত্র চেয়ে বসেন। এতে সময় ও হয়রানি দুই-ই বাড়ে।ভুক্তভোগীরা বলছেন, ‘ডিসি অফিস মানেই আতঙ্ক’শহরের মিরপুরের বাসিন্দা আছিয়া খাতুন বলেন, “আমার বাবার নামে থাকা জমির খতিয়ান তুলতে গিয়ে তিন মাস ঘুরেছি। প্রত্যেকবার নতুন কাগজ চায়, নতুন লোক চায়। শেষে এক দালালকে টাকা দিয়ে কাজ করাতে হয়েছে।

আরেক ভুক্তভোগী বলেন, “এখানে সবকিছুই টাকার ওপর নির্ভর করে। যাদের টাকা নেই, তাদের জন্য এই অফিস দুর্ভোগের নাম।”দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা যায়, গত পাঁচ বছরে ঢাকা ডিসি অফিসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অন্তত ৪৭টি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ঘুষ ও হয়রানির অভিযোগই বেশি। কয়েকজন কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হলেও বেশির ভাগ মামলার তদন্ত ঝুলে আছে।

দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, “ডিসি অফিসের দুর্নীতি একক নয়, এটা একটি চক্র। দালাল, অফিস সহকারী ও কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা মিলে ঘুষের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে।”ভূমি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন মনে করেন, “জমির নথি ও নামজারি প্রক্রিয়া পুরোপুরি অনলাইনে না গেলে দুর্নীতি কমবে না। প্রত্যেক ধাপে দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে ডিজিটাল ট্র্যাকিং চালু করতে হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)–এর সাম্প্রতিক এক জরিপেও বলা হয়েছে, নাগরিকদের হয়রানির দিক থেকে ভূমি অফিসগুলোর অবস্থান শীর্ষে, আর জেলা প্রশাসন অফিসগুলোর দুর্নীতি বাড়ছে। ঢাকা ডিসি অফিসের অনিয়ম, দালালি ও ঘুষের সংস্কৃতি বহু পুরোনো। প্রশাসন নানা সময়ে উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। ফলে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দপ্তরটি এখন অনেকের কাছে ‘জনসেবার কেন্দ্র’ নয়, বরং দুর্নীতির প্রতীকে পরিণত হচ্ছে।ই:প্র।

মন্তব্য করুন