
আজ জুমার নামাজের পর মুসল্লিদের সামনে ডিজিটাল স্ক্রিনে প্রকল্প উপস্থাপন । রোববার কার্যক্রম উদ্বোধন । মূল ভিত্তি অক্ষুণ্ন রেখে ৪তলা মসজিদের পাশে নির্মিত হবে ২০ তলা টাওয়ার ও ৩৫ তলা উচ্চতার মিনার, ব্যয় ২৬৯ কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিনিধি : অবশেষে চট্টগ্রামের অন্যতম ধর্মীয় পীঠস্থান আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ উন্নয়নের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ঐতিহাসিক মসজিদটিকে স্মারক হিসেবে মাঝে রেখে চারপাশে আট হাজার মুসল্লির একইসাথে নামাজ আদায়ের মতো চারতলা মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশে একটি ২০ তলা টাওয়ার এবং ৩৫ তলা উচ্চতার মিনার নির্মাণ করা হবে। বর্তমানে যেসব দোকান রয়েছে সেসব দোকানদারের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে ২৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে শহরের সবচেয়ে নান্দনিক একটি মসজিদ হিসেবে ঐতিহাসিক এই ধর্মীয় স্থাপনাটিকে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এই মসজিদ নির্মাণে সরকারের তরফ থেকে ১১ কোটি টাকা যোগান দেয়া হচ্ছে। বাকি টাকার সংস্থান স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক অনুদানের ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। আগামী রোববার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা মসজিদের নতুন প্রকল্পের কার্যক্রম উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। আজ জুমার নামাজের পরে মুসল্লিদের সামনে আটটি ডিজিটাল স্ক্রিনে মসজিদ নির্মাণের পুরো প্রকল্প উপস্থাপন করা হবে।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামের অন্যতম পুরাকীর্তি এবং ধর্মীয় পীঠস্থান হচ্ছে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। মুঘল আমলে নির্মিত মসজিদটি চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাচীন মসজিদগুলোর একটি। এই মসজিদের সাথে চট্টগ্রামে মোঘলদের বিজয় কাহিনীও জড়িত রয়েছে। ১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমেদ খাঁ এই আন্দরকিল্লার অন্দরে বা ভেতরে প্রবেশ করলে এর নাম হয়ে যায় ‘আন্দরকিল্লা’। চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ সালে এখানে নির্মাণ করেন ‘আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ।’ প্রায় একশ’ বছর পর ১৭৬১ সালে ব্রিটিশ সরকার এই মসজিদকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ১৮৮৫ সালে জমিদার হামিদুল্লাহ খাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং চট্টগ্রামের ওই সময়কার ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রচেষ্টায় মসজিদটি পুনরুদ্ধার হয়। ১৯৮৬ সালে সরকার মসজিদটি অধিগ্রহণ করে এবং এটি পরিচালনার দায়িত্ব ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে প্রদান করে।
মসজিদটির নকশার সঙ্গে দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের অনেক মিল বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, দিল্লি জামে মসজিদের আদলে এই মসজিদটিও বড় বড় পাথর ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছিল। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উঁচুতে পাহাড়ের ওপর অবস্থিত মূল মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৫৪ ফুট আর প্রস্থ প্রায় ২২ ফুট। প্রতিটি দেয়াল প্রায় আড়াই গজ পুরু। মূল মসজিদের পশ্চিমের দেয়ালটি পোড়ামাটির তৈরি। বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের। মধ্যভাগে একটি বড় এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা ছাদ আবৃত। মসজিদটিতে তিনটি মেহরাব থাকলেও এখন মাঝের সবচেয়ে বড়টাই ব্যবহার হচ্ছে।
বুজুর্গ উমেদ খাঁনের হাতে নির্মিত এবং গত সাড়ে তিনশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে কোটি কোটি মানুষের সেজদায় সিক্ত মসজিদটি চট্টগ্রামের মানুষের অন্যতম আবেগের জায়গা। বহু বছর আগ থেকে এই মসজিদের খতিব নিযুক্ত হন পবিত্র মদিনা শরিফের আওলাদে রাসুলগণ (সা.)। ফলে এটি ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে আরো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন সময় এই মসজিদ সংস্কার হয়েছে, সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে মসজিদটির সংস্কার না হওয়ায় দোতলার ছাদের পলেস্তার খসে খসে পড়ছে। পিলার গার্ডারের রড বেরিয়ে পড়েছে। ছাদ থেকে মেহরাবে পানি পড়ে। বৃষ্টির সময় বালতি বসিয়ে পানি ধরার অবস্থাও দেখা দিয়েছিল মসজিদে। করোনাকালে মসজিদের অবস্থা আরো নাজুক হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামের বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মসজিদে সহায়তার চেষ্টা করেও করতে পারেননি। কুয়েত ফান্ড থেকে ১৪৭ কোটি টাকা প্রদানের কথা বলা হলেও তাও হয়নি। ১৯৮৬ সাল থেকে সরকারিখাতে পরিচালিত মসজিদটি বেশ কিছু আইন কানুনের কারণে বহুমুখী সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
অবশেষে সরকার এবং স্থানীয় মুসল্লি পরিষদের মধ্যে চমৎকার একটি সমন্বয় হয়েছে। গ্রহণ করা হয়েছে চমৎকার একটি প্রকল্প। শহরের সবচেয়ে নান্দনিক এবং দৃষ্টিনন্দন একটি মসজিদের ডিজাইন করা হয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ বজলুর রশীদ বলেন, সাড়ে তিনশ’ বছর আগেকার মূল মসজিদটিকে অক্ষুণ্ন রেখে এর সামনে একটি খোলা চত্ত্বর রাখা হয়েছে। চারপাশে চারতলা উচ্চতার মসজিদে নামাজ, অজুখানা, মিলনায়তন, পার্কিংসহ নানা অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। মসজিদে একই সাথে অন্তত ৮ হাজার লোকের নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে মহিলাদের নামাজ আদায়ের আলাদা ব্যবস্থাও। মসজিদের পাশে নির্মিত হবে একটি ২০ তলা টাওয়ার। সেখানে দোকানপাটসহ অফিস স্পেস থাকবে। ওই টাওয়ারের পাশে আরো ১৫ তলা উঁচু করে মোট ৩৫ তলা উচ্চতায় নির্মিত হবে মিনার। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্র্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ হয়েছে ২৬৯ কোটি টাকা। এরমধ্যে প্রাথমিকভাবে সরকার প্রদান করছে ১১ কোটি টাকা। পরবর্তীতে সরকারের আরো অংশগ্রহণ থাকবে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, সবচেয়ে বড় সহায়তা আসবে বেসরকারি খাত থেকে। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক অনুদানে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদকে শহরের সবচেয়ে নান্দনিক মসজিদে পরিণত করার এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
আগামী ১২ অক্টোবর নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন বলে উল্লেখ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিডি মোহাম্মদ সারওয়ার আলম জানিয়েছেন, আজ বাদ জুমা মসজিদে মুসল্লিদের সামনে নতুন প্রকল্পের বিস্তারিত উপস্থাপন করে আগামী রোববার সকলকে সামিল হওয়ার দাওয়াত দেয়া হবে।
তিনি বলেন, আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ চট্টগ্রামের প্রাচীনতম একটি মসজিদ। এটিকে চট্টগ্রামের সবচেয়ে সুন্দর মসজিদে পরিণত করতেই সরকার এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, মসজিদটি নির্মিত হওয়ার পর পুরো আন্দরকিল্লার চেহারা পাল্টে যাবে ইনশাআল্লাহ।আ