
অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ননারী ও কন্যার উন্নয়ন’ প্রতিপাদ্য এবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস মাঠ কাপাচ্ছেন ১৮ জন ডিসি-সচিবালয়ে ১৪ জন সচিব
অনলাইন ডেস্ক : বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’ (কাজী নজরুল ইসলাম)। জাতীয় কবির ‘নারী’ কবিতার এই পঙক্তি বাংলা ব্যাকরণে ‘ভাব সম্প্রসারণ’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সত্যিই দেশের নারীরা আগের চেয়ে অনেক দূর এগিয়েছে। নারীরা এখন সেনা-বিমান-নৌ বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর উচ্চপদে কাজ করছেন। বিমানের পাইলট থেকে শুরু করে ট্রেনের ড্রাইভার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, শিক্ষকতা সবখানেই নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। প্রশাসনে সচিব থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা কাজ করছেন। কিন্তু সব সেক্টরে নারীরা কি সফল হচ্ছেন? মাঠ প্রশাসনে দক্ষতার সঙ্গে নারীরা তৃণমূলে যেমন কাজ করছেন, তেমনি রয়েছেন প্রশাসনের শীর্ষ পদেও। জনপ্রশাসনে, পুলিশ ও বিচার বিভাগে সরকারি চাকরিতে নারীদের অবস্থান দিন দিন আরো সংহত হচ্ছে। তবে বিগত দলী সরকারগুলোর সময় মাঠ প্রশাসনে যে পরিমাণ নারী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ৬৪ জেলা প্রশাসকের মধ্যে ১৮ জন নারী ডিসি এবং ৮১ সচিবের মধ্যে ১৪ জন নারী সচিব দায়িত্ব পালন করছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান বলেন, বর্তমান সরকার নারীবান্ধব। নারীর কর্মপরিবেশ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ায় আজ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে নারীরা নেতৃত্বে আছেন। এটি এক দিনে হয়নি। ধীরে ধীরে হয়েছে আগামীতে আরো বৃদ্ধি করা হবে। তবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের প্রত্যাহার করা চলমান রয়েছে।
‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ননারী ও কন্যার উন্নয়ন’ আগামীকাল শনিবার ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস, ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য। শুধু মাঠ প্রশাসনে নয়, এখন প্রশাসনের নানা স্তরে নারীর অবস্থান বাড়ছে, সুসংহত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পাশাপাশি মানুষের সচতেনতাও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। নারীদের জন্য কর্মপরিবেশও ভালো হয়েছে, তবে এখনো বেশ ঘাটতি আছে। এ জন্য কর্মপরিবেশ আরো উন্নত করা দরকার বলে মনে করেন নারী কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বিশেষ করে চাকরিজীবী মা-বাবার কথা বিবেচনা করে কর্মক্ষেত্রে উন্নত মানের ডে-কেয়ার আরো বৃদ্ধি করা উচিত। এ ছাড়া নারীর জন্য উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, পুরুষদের প্রথাগত মানসিকতা পরিবর্তনে সচেতনতা তৈরিসহ আরো কিছু কাজ করলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থান আরো সুসংহত হবে। প্রশাসনে নারীর অবস্থান বাড়লে তা নানা ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ফল নিয়ে আসবে বলে মনে করছেন নারী কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সচিব বর্তমান সরকার নারীবান্ধব। নারীর কর্মপরিবেশ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়ায় আজ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে নারীরা নেতৃত্বে আছেন। ধীরে ধীরে বাড়ানো হচ্ছে। তিনি আশা করেন, আগামীতে প্রশাসনে নারীর অবস্থান আরো উচ্চমাত্রায় যাবে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও বিভিন্ন স্থানে ওই সরকারের সুবিধাভোগীদের পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে একযুগেরও বেশি সময় ধরে বঞ্চিত ও বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। সর্বশেষ জেলা প্রশাসক পদে পদায়ন নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছে সরকার। গত প্রায় মাসখানেক ধরে ব্যাপক যাচাই বাছাই করে ফিট লিস্ট তৈরি করা হলেও সেখানে বিগত সরকাররে সুবিধাভোগী ও আওয়ামী পরিবারের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে অনেকের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে গত ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে নজিরবিহীন বিক্ষোভ, হট্টগোলে জড়ান বঞ্চিত ও বৈষম্যবিরোধী কর্মকর্তারা। এসব ঘটনা তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে দুই দফায় ৫৯টি জেলায় ডিসি নিয়োগ দেয়ার পরে ৯টি জেলার ডিসি পদে নিয়োগ দেয়া প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। পাশাপাশি চারজনের পদায়নকৃত জেলা বদল করা হয়। পরে ৫১টি জেলার ডিসি তাদের নতুন পদে নিয়োগ করা হয়। তাদের মধ্যে ১৮ জন নারী ডিসি মাঠে কাজ করছেন। তবে প্রশাসনের চরম এ অস্থিরতার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের দুইজন যুগ্মসচিবকে দায়ি করছেন বিক্ষুব্ধরা। তাদের অভিযোগ, বিপুল পরিমাণ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ত্যাগী, বঞ্চিত ও যোগ্য কর্মকর্তাদের বাইরে রেখে আওয়ামী লীগ পরিবার সংশ্লিষ্ট এবং বিগত ১৫ বছরে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদেরই আবার ডিসি পদে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সেজন্য অবিলম্বে ডিসি নিয়োগ বাতিলের দাবি তাদের। ৫ আগস্ট বিগত আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাজ স্থবির হয়ে পড়ে। বিগত সরকারের সময়ে দৃশ্যমান কোনো কারণ ছাড়াই পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধার কারণে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজই করতে পারেনি মন্ত্রণালয়টি। কারণ মন্ত্রণালয়টির সিনিয়র সচিবকে তারা সবসময় সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে সরকারি চাকরিজীবী আছেন, মঞ্জুরিকৃত পদ, মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ২১৭৯১ অধিদফতর ও দফতর ১৪৬৪১৪৫, কর্পোরেশন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ৪৩০৫৮৩, মোট ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৫১৯ জন। এর মধ্যে ৪ লাখ ৪ হাজার ৫৯১ নারী। প্রথম শ্রেণিতে (এখন গ্রেড ভিত্তিতে চাকরি নির্ধারণ হলেও মুখে মুখে শ্রেণি বলা হয়) মোট চাকরিজীবী আছেন ১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৭৯ জন। এর মধ্যে নারী ৩৯ হাজার ৭৮৭ জন। সব মিলে প্রশাসনে ১ হাজার ৫শত ৭৪ জন নারী কর্মকর্তারা রয়েছে। বর্তমানে প্রশাসনে মোট ৮১ জন সচিব আছেন। এর মধ্যে নারী সচিব ১৪ জন। মহিলা শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম মমতাজ আহমেদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান নাসরীন আফরোজ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন, বেসাময়িক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান, বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারজানা মমতাজ, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম মাহবুবা ফারজানা, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ড. কাইয়ুম আরা বেগম, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলোয়া আক্তার, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিব জাহেদা পারভীন এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ এবং বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক শরিকা খান। তারা গুরুত্বপূর্ণ দফতরগুলোর শীর্ষ পদ নারী কর্মকর্তারা সামলাচ্ছেন। শুধু মাঠ প্রশাসনে নয়, এখন প্রশাসনের নানা স্তরে নারীর অবস্থান বাড়ছে, সুসংহত হচ্ছে। নারীদের জন্য কর্মপরিবেশও ভালো হয়েছে, তবে এখনো বেশ ঘাটতি আছে। এ জন্য কর্মপরিবেশ আরো উন্নত করা দরকার বলে মনে করেন নারী কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বিশেষ করে চাকরিজীবী মা-বাবার কথা বিবেচনা করে কর্মক্ষেত্রে উন্নত মানের ডে-কেয়ার আরো বৃদ্ধি করা উচিত। প্রশাসনে নারীর অবস্থান বাড়লে তা নানা ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ফল নিয়ে আসবে বলে মনে করছেন নারী কর্মকর্তারা।
প্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি শাখার সূত্রে জানা গেছে, মাঠ প্রশাসন সামলাচ্ছেন ১৮ জন নারী ডিসি: বর্তমানে ৬৪ জেলা প্রশাসকের মধ্যে ১৮ জন নারী। এর মধ্যে রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম জেলার প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নুসরাত সুলতানা। ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইশরাত ফারজানা, রাজশাহী বিভাগের বগুড়া জেলা জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হোসনা আফরোজা, রাজশাহী জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আফিয়া আখতার। জয়পুরহাট জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আফরোজা আক্তার চৌধুরী, নাটোর জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আসমা শাহীন। জামালপুর জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হাছিনা বেগম, বান্দরবান জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শামীম আরা রিনি, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফরিদা খানম, গাজীপুর জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নাফিসা আরেফীন, টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শরীফা হক, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজিয়া খান, মেহেরপুর জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সিফাত মেহনাজ, নড়াইল জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শারমিন আক্তার জাহান। এ বিষয়ে বগুড়া জেলার প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হোসনা আফরোজা বলেন, একজন নারীকে নিজেকেই প্রমাণ করতে হয়, তিনি সে পদের যোগ্য কি না। তবে ধীরে ধীরে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরো পরিবর্তন হবে।
উপজেলা নিবার্হী অফিসার পদে ১৭৭ জন নারী মাঠ দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে প্রায় ২০ জনের পদোন্নতি জনিতকারণে বদলি করা হয়েছে। এছাড়া সারা দেশে ৪৯২ ইউএনওর মধ্যে ১৭৭ জন নারী। দায়িত্বরত ইউএনওদের মধ্যে এই হার ৩৬ শতাংশ। উপজেলা প্রশাসনে ইউএনও পদই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁরাই উপজেলায় সরাসরি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। তাঁরা উপজেলার অন্য সরকারি দফতরগুলোর কাজে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়া সারা দেশে ভূমিসংক্রান্ত দফতর সহকারী কমিশনার (ভূমি) আছেন ১৩৮ নারী। তবে আগামীতে মাঠ প্রশাসনে উপজেলা নিবার্হী অফিসার পদে এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসার মাঠে দায়িত্ব বাড়ানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার রিনাত ফৌজিয়া ইনকিলাবকে বলেন, সমাজে ধীরে ধীরে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরো পরিবর্তন হবে। আমি মাঠ কাজ করে জনগণের সেবা দিতে পারছি। এই আমরা বড় পাওয়া।ই