বন্যা মোকাবিলায় জাতি ঐক্যবদ্ধ

ত্রাণ বিতরণে আরো সমন্বয় প্রয়োজন টিএসসিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের চলছে গণত্রাণ সংগ্রহ : অনেক সরকারি-বেসরকারি সংস্থাই দিয়েছে এক দিনের বেতন : এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী : ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন : কাজ করছে ১১৯৬ মেডিক্যাল টিম : টানা বৃষ্টিতে লক্ষ্মীপুরে বন্যার অবনতি

অনলাইন ডেস্ক : ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কান্ডারি! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতার পংক্তির মতোই দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই আজ বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাংবাদিক সংগঠনসহ সারাদেশের সর্বস্তরের মানুষ বন্যা মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সব মানুষের কন্ঠে আজ মনবতার জয়গান। সবাই আজ বন্যা দুর্গতদের পাশে।

মাদ্রাসার শিক্ষক-শির্ক্ষীরা যেমন তাদের সর্বোচ্চ সামর্থ নিয়ে বন্যা কবলিত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করছে, তেমনি হিন্দুরাও তাদের পুজায় যে টাকা খরচ হতো তা বাঁচিয়ে বন্যার্তদের সাহায়্যে দান করছে। এ এক অভূতপূর্ব মানবিকতার দৃশ্য। এটাই বাংলাদেশের প্রকৃতরূপ। গত ২১ আগস্ট দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের ১২টি জেলায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। এতে প্রায় ১০ লাখ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ৫০ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বয়াবহ বন্যার শুরু থেকেই দুর্গম এলাকা থেকে বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা, ত্রাণ বিতরণসহ নানা ধরনের মানবিক কাজ সরকারি বিভিন্ন সংস্থাসহ সর্বস্তরের মানুষজন করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল চতুর্থ দিনের মতো ‘গণত্রাণ’ সংগ্রহ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে তারা কেন্দ্রীয়ভাবে এ বিশাল কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন।

অন্য যেকোনো দুর্যোগের চেয়ে এবারের বন্যায় ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতায় অভূতপূর্ব ঐক্য দেখা যাচ্ছে। বানভাসি মানুষের জন্য একাট্টা হয়েছে সবাই। ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ীগোষ্ঠী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ কার্যক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সবাই। এ কাজে তরুণসমাজের এগিয়ে আসার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে দলীয় পরিচয়ে ছাত্রদের উপস্থিতি না থাকায় এবার তা সর্বজনীন রূপে হাজির হয়েছে। উদ্ধার তৎপরতার জন্য কেউ কেউ দলীয়ভাবে নৌকা বা স্পিডবোটের ব্যবস্থা করছেন, ত্রাণের ব্যবস্থা করছেন। আবার বন্যাকবলিত এলাকায় যাঁদের বড় ভবন রয়েছে, তাঁরা তা আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ভরা এখন ত্রাণকাজের ছবি, ভিডিও আর এসংক্রান্ত হরেক রকম আবেদনে। বিভিন্ন গ্রুপ, সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও মানুষ এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরেছে তাদের আহবান, অনুরোধ, অভিমত, অভিজ্ঞতা। মুঠোফোন নম্বর, ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর, যোগাযোগের ঠিকানা এসব তুলে দিচ্ছে। মানুষ তাতে স্বতস্ফূর্তভাবে সাড়াও দিচ্ছে। বন্যার্তদের সহযোগিতায় এক দিনের বেতনের সমপরিমাণ অর্থ দিয়েছেন সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সব পদবির সদস্যরা। একই সঙ্গে তাঁরা উদ্ধার তৎপরতায় সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি পৃথকভাবেও ত্রাণ দিচ্ছেন। সরকারি-বেসকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে সহায়তা করছে। কোনো সংস্থা এক দিনের বেতন, আবার কেউ অর্থসহ নানা সহায়তা করছে। সরকারের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। বন্যার্তদের সহায়তায় এক দিনের বেতন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এক দিনের বেতন দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিকাশ ও নগদের সব কর্মীও তাঁদের এক দিনের বেতন দিয়েছেন। ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত ফেনীতে বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় ত্রাণ বিতরণ করছে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন।

বন্যাকবলিত এলাকায় সহযোগিতার জন্য ত্রাণ সংগ্রহের কাজ করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) প্রাঙ্গণে চলছে ত্রাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ। টিএসএসসির প্রবেশপথের পাশে ‘গণ-ত্রাণ সংগ্রহ’ বুথ বসানো হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে সাধারণ মানুষ এসে নানা ধরনের ত্রাণ এখানে দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে অভূতপূর্ব সাড়া পাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। সাধারণ মানুষ যার যা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে তা নিয়েই হাজির হচ্ছে টিএসসিতে। এগুলো পৌঁছানো হচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকায়। গতকাল টিএসসি চত্বরে গিয়ে দেখা যায়, দিনমজুর-রিকশাচালক থেকে শুরু করে নানা বয়স, শ্রেণি-পেশার সর্বস্তরের মানুষ সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়ে ছুটে আসছেন। সবার হাতে চাল, ডাল, আলু, তেল, খাবার স্যালাইন, লবণ, বিশুদ্ধ পানি, খেজুর, চিড়া, মুড়ি, বিস্কুটসহ নানা ধরনের শুকনো খাবার। রয়েছে নগদ টাকা, কাপড়-চোপড়, লাইফ জ্যাকেট, শিশুখাদ্য, পশুপাখির খাদ্য, ওষুধ, স্যানিটারি প্যাডসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই। বিভিন্ন দুর্যোগে ঢাবি শিক্ষার্থীরা অনেকবার ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন; কিন্তু এবারের মতো বড় আয়োজন এর আগে কখনো দেখা যায়নি। গতকালও সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণে দিনভর টিএসসিতে ছিল মানুষের ঢল। বিশেষ করে বিকেলে এখানে পা ফেলার জায়গা ছিল না। দিনভর ও রাতের একটি অংশ ত্রাণ সংগ্রহ চললেও এসব ত্রাণ প্যাকেজিং করতে সারারাত টিমভিত্তিক শ্রম দিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের এবং ত্রাণ সংগ্রহ করতেও রীতিমতো খেতে হচ্ছে হিমশিম। এ ছাড়া টিএসসি এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণসহ ত্রাণ বহন ও প্যাকেজিং করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষার্থীরাই। টিএসসিতে গণত্রাণ সংগ্রহ ফান্ডে এ পর্যন্ত নগদ প্রায়২ কোটি টাকাও সাধারণ মানুষ দিয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, দুর্গত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণত্রাণ সংগ্রহ চলবে। এতে মানুষ অভূতপূর্ব সাড়া দিচ্ছেন। এটিকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দল-মত নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করছেন। এ টাকা খরচের পর সংগৃহীত টাকার হিসাব দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। রাজধানীসহ সারা দেশে পথে পথে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে ত্রাণ সংগ্রহের কাজ। তবে এখন ত্রাণ তহবিল ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ, ত্রাণকাজে নানা রকম উপকরণ দান ও সরাসরি অংশ নিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বড় ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে ফেসবুক ত্রাণকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের যোগাযোগ, অভিজ্ঞতা বিনিময়, পরামর্শ, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও সংগ্রহের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

আকস্মিক বন্যায় এক হাজার ১৯৬টি মেডিক্যাল টিম সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করছে। আক্রান্ত এলাকায় পর্যাপ্ত পানি, বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং হাসপাতালগুলোতে জরুরি মেডিক্যাল টিমসহ পর্যাপ্ত ওরাল স্যালাইন, কলেরা স্যালাইন, অ্যান্টিভেনমসহ অন্যান্য জরুরি ওষুধ মজুদ রাখা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। এসব এলাকার সব স্বাস্থ্যকর্মী ও কর্মকর্তার ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ উদ্ধারকাজ পরিচালনা। পূর্বাঞ্চলের মানুষ বন্যার সঙ্গে পরিচিত নয়। ফলে কিভাবে নিজেদের রক্ষা করতে হয় সে বিষয়ে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে এখন দীর্ঘদিন ত্রাণ লাগবে তাদের। সেটা বিতরণে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা করা জরুরি। সবাই যার যার জায়গা থেকে সহায়তা করবেন, কিন্তু সেটা বিতরণের ব্যাপারে যদি সমন্বিত রূপ না থাকে তাহলে দেখা যাবে এক অঞ্চলের মানুষ বেশি সাহায্য পাবে, আবার কোনো কোনো জায়গার মানুষ বঞ্চিত রয়ে যাবে।

বন্যাদুর্গত এলাকায় মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। অনেক স্থানে এখনো বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করছে। বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সঙ্কট ও অনেক স্থানে আছে এমন অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। প্রচুর ত্রাণ সামগ্রী থাকলেও সমন্বয়হীনতার কারণে এখনো অনেক স্থানে ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। এসব বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বন্যা কবলিত এলাকার সর্বশেষ তথ্য নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদন নিচে তুলে ধরা হলো।

নোয়াখালী : ভয়াবহ বন্যার পানি অপসারণে কোম্পানীগঞ্জের মুছাপুর রেগুলেটরের ২৩টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। সেখানে প্রতি সেকেন্ডে ৭৫০ ঘনমিটারেরও বেশি পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে। তবে পূনরায় থেমে থেমে বৃষ্টিতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জনমনে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। জেলায় বন্যার পানি ৪ থেকে ৫ ইঞ্চি নেমে গেলেও শনিবার রাতের বৃষ্টিতে এবং গতকাল রোববার থেমে থেমে পুনরায় বৃষ্টি হয়ে আবারো পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সর্বত্র একধরনের ভীতি বিরাজ করছে। জেলার আট উপজেলার ২০ লাখ মানুষ বন্যা কবলিত। এরমধ্যে ৮৬৬ আশ্রয়কেন্দ্রে এক লাখ ৫৩ হাজার মানুষকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। এতে সকল মানুষকে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, স্যালাইনসহ গোখাদ্য সরবরাহ চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারির ছুটি বাতিল করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : কসবা ও আখাউড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো উন্নতি হয়েছে। গতকাল রবিবারও পানি কমেছে দুই উপজেলাতেই। কসবায় কিছু সড়কে পানি থাকলেও বেশির ভাগ জায়গার বাড়ি-ঘর থেকে পানি সরে গেছে। আখাউড়ায় বন্যার পানি না থাকলেও কিছু বাড়িতে জলাবদ্ধতার কারণে পানি দেখা যায়। এদিকে পানি শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্যার ক্ষত চিহ্ন বের হচ্ছে। আখাউড়ার কেন্দুয়াই, রাজেন্দ্রপুর, খলাপাড়া, ইটনা, আইড়ল, কর্ণেল বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায় বেশি কিছু বাড়ি-ঘর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ভাসতে শুরু করেছে ডুবে যাওয়া জমি। তবে এসব জমিতে লাগানো বেশির ভাগ ধানের চারা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। একই অবস্থা কসবা উপজেলাতেও। এদিকে আখাউড়া স্থলবন্দও দিয়ে রবিবার বিকেল থেকে যাত্রী পারাপার শুরু হয়েছে। বন্যার কারণে যারা ভারতে কিংবা বাংলাদেশে আটকা পড়েছিলেন তাদের ভিসা শেষ হয়ে থাকলেও বিশেষ বিবেচনায় যেতে দেওয়া হচ্ছে।

লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। ফেনী ও নোয়াখালী জেলার বন্যার পানি রহমতখালী খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরের লোকালয়ে ঢুকে ক্রমশ পানি বাড়ছে। জেলার ৮০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে। পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ। ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কায় হাস, মুরগী ও গবাদীপশুসহ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটছে। সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, যুব রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা পানিবন্দি বাসিন্দাদের উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে। জেলায় ৫০ হাজার মানুষ এখন বিদ্যুৎহীন অবস্থায় আছে। স্থানীয়রা জানায়, ফেনী ও নোয়াখালী জেলা থেকে বন্যার পানি লক্ষ্মীপুরে প্রবাহিত রহমতখালী, ওয়াপদা ও ভুলুয়া খাল দিয়ে হু হু করে পানি লক্ষ্মীপুরের লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। রহমতখালী খাল, রামগতি, কমলনগরের ভুলুয়া নদী, রামগঞ্জের ওয়াপদা, বিরেন্দ্র খাল, রায়পুরের ডাকাতিয়া নদীসহ বিভিন্ন স্থানে নদী-খাল দখল করে বাধদিয়ে মাছ চাষ, সেতু, কালভার্ট, রাস্তা, দোকানপাটসহ স্থাপনা নির্মাণ করায় বন্যার পানি মেঘনা নদীতে নামতে বেগ পেতে হচ্ছে, ফলে ব্যাপক পানিবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।

রামগতি (লক্ষ্মীপুর) : লক্ষ্মীপুরের রামগতি-কমলনগরে গত শনিবার রাতভর ও কাল সারাদিনের টানা বৃষ্টিতে বন্যার আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে কোথাও এক ফুট আবার কোথাও দুই ফুট পানি বেড়েছে বলে জানিয়েন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। উপজেলার অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে লক্ষাধিক মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে। এ ছাড়া অনেক জায়গায় বন্যাকবলিত মানুষ ত্রাণ পায়নি। দ্রুত ত্রাণ পাঠানোর দাবি জানিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। রামগতি-কমলনগর ২৬ টি গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ এতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। জলাবদ্ধতার এ পানি কোথাও সরছে না। এদিকে বিশুদ্ধ পানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত নানা রোগবালাই।

লাকসাম-মনোহরগঞ্জ (কুমিল্লা) : ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া কুমিল্লা জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার ৮০শতাংশ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। চারদিকে বানভাসি মানুষের হাহাকারের মধ্যে দেখা দিয়েছে ত্রাণ ও সুপেয় পানির সংকট। কুমিল্লায় আকস্মিক বন্যায় সবার প্রথমে প্লাবিত হয় জেলার লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা। কুমিল্লা জেলার মধ্যে সারাদেশ থেকে উদ্ধার কর্মী ও ত্রাণ বেশি প্রবেশ করেছে দাউদকান্দি, বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া ও মুরাদনগর এলাকায়। অন্যদিকে ত্রাণ পাচ্ছেন না, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার লাখ লাখ পানিবন্দি মানুষ। গতকাল রোববার সকালে এ দুই উপজেলার বানভাসি মানুষেদের সঙ্গে কথা এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এদিন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মুসফিকুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত জেলার ১৪টি উপজেলায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ৮ লাখ ২৪ হাজার ৩৯২ জন। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ৬১ হাজার ৪৪৫ জন।

বন্যা দুর্গত এলাকায় কুমিল্লা মুরাদনগরে আলীচর ও সোনাপুর বেড়িবাদের দুই পাশে প্রায় দুই শতাধিক ঘর বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। গ্রামবাসি আশ্রয় নিয়েছে বাধে খোলা আকাশের নিচে। বন্যার্তদের মাঝে বিএনপি নেতা সাবেক এমপি কায়কোবাদের পক্ষ থেকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে ত্রাণ বিতরণ করছেন। নৌকা দিয়েও দুর্গত এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে তার খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন। এদিকে গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্ট দেখে আশ্রয় কেন্দ্রে জন্ম নেওয়া আবু সাঈদের দেখ-ভালের দায়িত্ব নিয়েছে কায়কোবাদের লোকজন। তারা গতকাল শিশুটির খাবারের জন্য দুধসহ যাবতীয় প্রযোজনীয় জিনিস আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে তার মায়ের কাছে দিয়ে এসেছেন।

রামগড় (খাগড়াছড়ি) : খাগড়াছড়ি পার্বত্যাঞ্চলের চেঙ্গী নদী, ফেনী নদী, পিলাক নদী ও বিভিন্ন ছড়ার পানি কমায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। বর্তমানে খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা, মহালছড়ি ও পানছড়ি, মাটিরাঙা, গুইমারা, লক্ষীছড়ি, রামগড় ও মানিকছড়ি উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির খবর পাওয়া গেছে। এদিকে চেঙ্গী ও ফেনী নদীসহ পাহাড়ী ঢল অব্যাহত থাকায় রামগড় উপজেলার নিম্নাঞ্চল ও দীঘিনালার মেরুং ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রাম এখনও পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ চলমান রয়েছে। পাহাড়ের প্রত্যান্তঞ্চলে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট রয়েছে বলে তথ্য খবর পাওয়া গেছে।ই

মন্তব্য করুন