নিজস্ব প্রতিনিধি : বড় ধরনের কোনো অঘটন কিংবা অভিযোগ ছাড়াই গতকাল বুধবার উৎসব মুখর পরিবেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। দীর্ঘ ৩৬ বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ছোটখাট কিছু অসঙ্গতি ছাড়া ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া ছিলো অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ। জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দিতে পেরে অনেক শিক্ষার্থীকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫টি অনুষদ ভবনে চলে ভোটগ্রহণ। ওই পাঁচটি ভবনে ১৮টি হল ও একটি হোস্টেলের শিক্ষার্থীরা ভোট দেন। মোট ৬০টি কক্ষে বুথ ছিলো ৬৮৯টি। বেশ কয়েকটি বুথে নির্ধারিত সময়ের পরেও শিক্ষার্থীদের লাইন থেকে যাওয়ায় ভোট দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। ভোটারের উপস্থিতির হার ৬০ শতাংশের বেশি বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।
ভোটগ্রহণ শেষে কেন্দ্র থেকে ব্যালেটগুলো আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হয় ৫টি ডিন কার্যালয়ে। সেখানে বিকেল সোয়া ৫টায় শুরু হয় ক্যামেরার সামনে ভোট গণনা। পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতিতেই গণনা চলছে বলে জানান, নির্বাচন কমিশনার প্রফেসর মো. আনোয়ার হোসেন। ভোট গণনার স্ক্যানিং হবে ইমেজ আকারে। সেই ইমেজকে দুইটা প্যারালাল স্ক্যানিং করা হবে। নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ভোট গণনা করবেন। তাদের বাইরে বিশ্ব বিদ্যালয়ের আইটি সেলের প্রোগ্রামার আলাদাভাবে গণনা করবেন। ২টি মিলে গেলে ভোটের ফলাফল প্রকাশ করা হবে। পুরো ফলাফল পেতে ভোট গণনার শুরু থেকে ৭-৮ ঘণ্টা সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন আইটি সেলের প্রধান অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী। ৫টি ডিন কার্যালয় থেকে আলাদাভাবে হল সংসদের ফলাফল ঘোষণা করা হবে। আর কেন্দ্রীয় সংসদের ফল ঘোষণা হবে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের সামনে। ফল গণনার পুরো বিষয়টি সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
এদিকে ভোট গণনাকে ঘিরে রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে উৎসব মুখর পরিবেশ ছিল। সকালে ভোট শুরুর আগেই প্রতিটি কেন্দ্রের সামনে ছিলো শিক্ষার্থীদের ভিড়। সকাল থেকে প্রার্থীরা নানা অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ তোলেন। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে অমোচনীয় কালি ব্যবহার না করার অভিযোগ করা হয়। দুই ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের উপস্থিতি নিয়ে অভিযোগ দেন। কয়েকটি কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারের সাক্ষর ছাড়াই ভোট নেওয়ার অভিযোগ উঠে।
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের পক্ষ থেকে ভিপি প্রার্থী সাজ্জাত হোসেন ভোটারদের আঙ্গুলে দেয়া কালি উঠে যাওয়ায় জাল ভোটের আশঙ্কা প্রকাশ করেন। একই আশঙ্কা ব্যক্ত করেন ছাত্রশিবিরে ভিপি প্রার্থী ইব্রাহিম রনি। প্রার্থীদের প্রায় সবাই ভোটগ্রহণে ধীর গতির অভিযোগ করেন। ছাত্রদল নেতারা বলেন, ভোট বর্জন নয়, কোন অনিয়ম, কারচুপি হলে তা প্রতিহত করবো। অন্যদিকে ছাত্রশিবিরের নেতারা বলেছেন, জয়-পরাজয় যা-ই হোক শিবির তা মেনে নেবে।
এদিকে প্রার্থীদের প্রতিটি অভিযোগের জবাব দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন থেকে চকবাজার, কোথাও অমোচনীয় কালি মেলেনি। আর এই কারণে সাধারণ কালি ব্যবহার করা হয়েছে। এতে জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই দাবি করে তিনি বলেন, ছবিসহ ভোটার তালিকা থাকায় অমোচনীয় কালির গুরুত্ব কমেছে। অধ্যাপক মনির উদ্দিন বলেন, আমরা আগে নিশ্চিত করেছি আমাদের ভোটারদের পরিচিতি হলো তাদের আইডি নম্বর এবং ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা। পোলিং এজেন্টদের কর্তব্য- যারাই ভোটকেন্দ্রে ঢুকবে, তাদের ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা দেখে নিশ্চিত করবে, তিনিই প্রকৃত ভোটার। তাই অমোচনীয় কালিটা এটা এখন আর আমাদের জন্য ম্যান্ডেটরি রইল না।
ভোটগ্রহণে ধীরগতি নিয়ে তিনি বলেন, একজন ভোটারকে অনেক ভোট দিতে হয়। এই কারণে শুরুতে কিছুটা গতি কম ছিলো, পরে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। চারটার পরও ভোট নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ধীর গতিতে হোক আর যাই হোক; আমরা বলেছি, ৪টা পর্যন্ত কেন্দ্রের চৌহদ্দিতে যদি কেউ প্রবেশ করেন যতক্ষণ পর্যন্ত ভোট নিতে হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ভোট নেব।
ভোট গ্রহণে বিলম্ব হওয়ার কারণ কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা লেইট হয় নাই। অনেক জায়গাতে শুরু হয়েছে। কোন কোন জায়গাতে নয়টা থেকে কিছু লেইট হয়েছে। আপনারা জানেন প্রস্তুতি, পরিবহনসহ অনেক কিছু ছিলো। বিজ্ঞান অনুষদ ভবনে ব্যালট বাক্সে স্বাক্ষরহীন ১২টি ব্যালট মিলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক মনির বলেন, ওখানকার রিটার্নিং অফিসার জানিয়েছেন, উনি শুরুতে যে ব্যালট দিয়েছেন ওই ব্যালটে সাইন করেন নাই। আমি এখন সিদ্ধান্ত দিয়েছি, সেটা হচ্ছে একটা রেজ্যুলেশন করা যে এই বাক্সগুলোর মধ্যে ১২টা ভোট আছে, যেটার মধ্যে স্বাক্ষর নাই; সেই রেজ্যুলেশনে পোলিং, রিটার্নিং ও প্রিজাইডিং অফিসার সেখানে যারা আছেন-সবাই সাক্ষর করবেন। এবং ওই বাক্সগুলো যখন আমরা যাচাই করব, সেখানে ১২টা ভোট স্বাক্ষর ছাড়া আছে, সেটা জানা থাকলে আর কনফিউশনের জায়গা থাকবে না।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৫১৭ জন। এর মধ্যে ছাত্র ১৬ হাজার ৮৪ জন এবং ছাত্রী ১১ হাজার ৪৩৪ জন। চাকসু ও হল সংসদ মিলিয়ে ভোটের লড়াইয়ে ছিলেন ৯০৮ জন প্রার্থী। এর মধ্যে চাকসুতে ২৬টি পদে ৪১৫ জন এবং হল সংসদে ৪৯৩ জন প্রার্থী। কেন্দ্রীয় সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪৮ জন নারী প্রার্থী ও ৩৬৬ জন পুরুষ প্রার্থী। এছাড়া ২৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছাত্রদলের
চাকসুর ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছে ছাত্রদল। বিকেল সোয়া চারটার দিকে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের সামনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান সাংবাদিকদের বলেন, এই নির্বাচন কমিশনার অথর্ব নির্বাচন কমিশনার। এই মেরুদ-হীন নির্বাচন কমিশনারের কাছ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা-আস্থার জায়গা নষ্ট হয়ে গেছে।
নোমান বলেন, একটা প্যানেলের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের আটটি অভিযোগ এসেছে। আচরণবিধি লঙ্ঘনের যে শাস্তি সে শাস্তি নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত করতে পারেনি। কারণ একটা, বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার স্বার্থে।
তিনি বলেন, এই প্রশাসন জামায়াতি প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন মেরুদন্ডহীন। এটা জানার পরও আমরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখার স্বার্থে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি। কিন্তু আমরা দেখেছি ডাকসু ও জাকসুর ন্যায় এটিও একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন হতে যাচ্ছে।
ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশন আমাদের আশ্বস্ত করেছিল ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে যে অভিযোগগুলো এসেছে, অনিয়ম হয়েছে, কারচুপি হয়েছে; সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে চাকসু নির্বাচনকে সুষ্ঠু নির্বাচনরূপে আমাদের কাছে উপহার দেবেন। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন, তারা অমোচনীয় কালি দেবেন। কিন্তু তারা সেখানে ব্যর্থ হয়েছেন।
ভোট দেয়া শেষে ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীরা আমাদের যে রায় দেবেন, আমরা তা মেনে নেব। জয়-পরাজয় যেটিই হোক, আমরা অতীতে যেভাবে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম সেভাবেই থাকব। তবে যে প্রক্রিয়ায় ভোট গ্রহণ হচ্ছে সেটি দুঃখজনক।ই