হাসিনার স্বৈরশাসন : ২০০৯-২০২৪, গোপালীদের দাপটে কলঙ্কিত পুলিশ বাহিনী

অনলাইন ডেস্ক : ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর হাসিনা তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য মাস্টারপ্ল্যান করেন। এই মাস্টারপ্ল্যান ছিল বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে। কারণ তিনি জানতেন পুলিশকে যদি বশে আনা যায় তাহলে দেশের মানুষকে শায়েস্তা করা সহজ হবে। তারা চুপ হয়ে থাকবে।

জানা গেছে, হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পুলিশ বাহিনীতে ৩২ হাজার সদস্য নিয়োগ করা হয়। যার মধ্যে ৮ হাজার ছিল গোপালগঞ্জ জেলার। নিয়োগের ক্ষেত্রে এই দলীয়করণের আদেশ আগেই দিয়ে রেখিছিলেন হাসিনা। এখান থেকেই পুলিশ বাহিনীতে দুর্নীতি শুরু হয়। এক পর্যায়ে গোপালগঞ্জের পুলিশ সদস্যরা নিজেদেরকে ‘গোপালী’ বলে পরিচয় দিতে রীতিমতো গর্ববোধ করতো। বিশেষ করে বিসিএস ক্যাডারভুক্ত ‘গোপালী’ কর্মকর্তারা রাতারাতি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে পুলিশ বাহিনীতে। ‘গোপালী’ হিসাবে তারা খুব সহজেই হাসিনার সুনজরে চলে আসে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশের উর্ধ্বতন গোপালী কর্মকর্তাদের প্রাইজ পোস্টিং দেয়া হয়। গোপালীরা হয়ে ওঠেন পুলিশ বাহিনীর মহীরুহ। তারা এতটাই ক্ষমতাধর ছিল যে, তাদের দাপটে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তটস্ত থাকতো। এমনি একজন ডিএমপির সাবেক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। হাসিনার পতনের পর যাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ১৯৯৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ১৭তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন হাবিব। তিনি ঢাকা জেলায় এসপি থেকে শুরু করে পদোন্নতিক্রমে বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তরে অতিরিক্ত সহকারী মহাপরিদর্শক (সংস্থাপন) হিসেবে পদস্থ হন। পরবর্তীতে তিনি উপ-মহাপরিদর্শক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১০ অক্টোবর ২০২২ উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) হাবিবুর রহমানকে ট্যুরিস্ট পুলিশ ইউনিটের প্রধান এবং ২০২৩ সালে তাকে ডিএমপি কমিশনার হিসেবে বদলি করা হয়। হাবিবুর রহমানকে বলা হয়, ‘মুখোশধারী কর্মকর্তা’। দলীয় লেজুরবৃত্তি করাই ছিল তার প্রধান কাজ। হাসিনার আনুগত্য লাভের জন্য তিনি ‘লেটারস অব শেখ মুজিব’ নামে একটা বই লেখেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে খুশি করার জন্য লেখেন ‘নন্দিত বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল’ নামে আরেকটি বই। এই দুই বইয়ের প্রকাশনা উৎসব করা হয় খুব ঘটা করে। যাতে সবাই বুঝতে পারে হাবিবের কী ‘দাপট’। সাধারণ পুলিশ কর্মকর্তারা হাবিবের দাপটের কাছে টিকতেই পারতেন না। হাবিবের কথাই ছিল পুলিশ বাহিনীতে অলিখিত আইন। নিজেকে অনাগত আইজিপি হিসাবেও জাহির করতেন তিনি। পুলিশ বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও হাবিবের কাছে ছিলেন তুচ্ছ। সিনিয়ররাও তাকে সমীহ করে কথা বলতেন। পেশাগত দক্ষতার চেয়ে হাবিব আওয়ামী লীগের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নেই ছিলেন বেশি দক্ষ। পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকাও হাতিয়েছেন। বিরোধীদলকে দমন পীড়নের জন্য হাবিবের কর্মকান্ড হাসিনার কাছে খুবই প্রশংসিত ছিল। এতে করে তিনি দিন দিন অসীম ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানোর আদেশদাতা এই হাবিব। আন্দোলন চলাকালে ডিএমপির যে সব থানা এলাকায় গুলিতে মানুষ মরে নি, সে সব থানার ওসিকে তিনি প্রকাশ্যে গুলি করে মানুষ হত্যা করে আতঙ্ক সৃষ্টি করার আদেশ দিয়েছিলেন বলে বেশ কয়েকজন ওসি স্বীকার করেছেন। তারা বলেন, কমিশনার স্যারের অর্ডারে আমরা বাধ্য হয়ে নিরীহ মানুষের উপর গুলি করেছি। তা না করলে চাকরি যাওয়ার হুমকী ছিল।

আরেক গোপালী পুলিশ কর্মকর্তা বনজ কুমার। মুসলিম বিদ্বেষী এই কর্মকর্তা বরাবরই ছিলেন বিতর্কিত। তবে গোপালী হওয়ায় তিনি হাসিনার গুডবুকে ছিলেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থাকার পর সর্বশেষ তাকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান করা হয়। বহুল আলোচিত নূসরাত হত্যা মামলায় দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে অনেক কিছুই পাল্টে ফেলেন বনজ কুমার। নন্দিত নায়ক সালমান শাহ হত্যা মামলাকেও টাকার বিনিময়ে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদও গড়েছেন এই গোপালী কর্মকর্তা।

গোপালী পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে আরেক আওয়ামী দালাল মনিরুল ইসলাম। হাসিনার শাসনামলে জঙ্গি দমনের নামে বহু নাটক মঞ্চস্থ করে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী তথা আলেম-ওলামাদের উপর দিনের পর দিন নির্যাতনের নায়ক এই মনিরুল। বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের জঙ্গি বানাতেও দ্বিধা করেন নি তিনি। ডিবি প্রধান থাকাকালে বিনা বিচারে বহু মানুষকে দিনের পর দিন ডিবি অফিসে আটকে রেখে নির্যাতন করেছেন। দিয়েছেন মিথ্যা মামলা। শুধু তাই নয়, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুমের নায়কও এই মনিরুল। হাসিনার পতনের সময় তিনি এসবি প্রধান হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তবে হাসিনার পতনের পর তাকেও চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এখন দাবি উঠেছে তার বিচারের।

হাসিনার আরেক আস্থাভাজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। শুধুমাত্র গোপালী হওয়ার কারণে এই কর্মকর্তার দম্ভ, অহংকার, দাপট ছিল অন্যরকম। কথিত আছে বেনজীরের কাছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও পাত্তা পেতেন না। হাসিনার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার গোপন নকশা বাস্তবায়নের জন্য তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর ২০১০ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যা চালান। এই সাথে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ইসলাম বিদ্বেষী বেনজীরের দুর্নীতি, হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি জবর দখলসহ নানা কীর্তিকলাপ ইতোমধ্যে দেশবাসী জেনে গেছে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হাসিনার বিশ্বস্ত সাবেক এই আইজিপি এখন দেশান্তরী হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

আরেক গোপালী কর্মকর্তা খোরশেদ হোসেন। র‌্যাবের মহাপরিচালক খোরশেদ হোসেনকেও ইসলামবিদ্বেষী হিসাবে সবাই জানে। কথায় কথায় হাসিনার দালালি করতে সিদ্ধহস্ত খোরশেদ হোসেন বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানীসহ বহু মিথ্যা মামলা করেছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ তার বিরুদ্ধে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গুম করারও অভিযোগ রয়েছে।

হাসিনার শাসনামলে ১৫ বছর ৭ মাসে ডিএমপিতে গোপালী ইন্সপেক্টরদের ঢালাওভাবে থানার ওসি হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে জামায়াত নিধনের মিশন হিসাবে গোপালীদেরকে থানায় থানায় ওসি হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। এক পর্যায়ে ডিএমপির ৫০টি থানার মধ্যে কমপক্ষে ৩৪টি থানায় গোপালীরা ওসি হিসাবে নিয়োগ পাওয়ায় বিরোধীদলের উপর জুলুম নির্যাতন বেড়ে যায়। তেমনই এক কর্মকর্তা শাহবাগ থানার ওসি (অপারেশন) আরশাদ হোসেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ‹মার্চ ফর জাস্টিস› কর্মসূচি চলাকালে ঢাকার নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী নাহিদুল ইসলামের মুখ চেপে ধরে পুলিশ পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন আলোচনায় আসেন। হাসিনার পতনের পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আলাপকালে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, মূলত পুলিশ বাহিনীকে গণবিরোধী বানানোর রুপকার ছিলেন গোপালীরা। তাদের দাপটে অন্য জেলার কর্মকর্তারা অসহায় হয়ে পড়েছিল। অন্য জেলার পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রমোশন না দিয়ে গোপালীদের প্রমোশন দিয়ে হাসিনা সরকার বহু কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করেছে। কেউ কেউ বলেছেন, হাসিনার পতনের জন্য দায়ী পুলিশ বিভাগে দলীয়করণ। এটা না করা হলে পুলিশ জনগনের আস্থাভাজন হয়ে থাকতো। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে হাসিনা গোপালীদেরকে প্রমোট করে নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছে।ই

মন্তব্য করুন