
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় মাইকে ডাকাত আসার ঘোষণা দিয়ে জোড়া খুনের ঘটনায় পরিস্থিতি থমথমে
নিজস্ব প্রতিনিধি : চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ২ জনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা পরিকল্পিত হত্যা বলছেন জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা। তবে তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে তারা সরাসরি কিছু বলছেন না। নিহতের স্বজনেরাও অভিযোগ করেছেন, তাদের সালিস বৈঠকের কথা বলে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরে মসজিদের মাইকে ডাকাত এসেছে ঘোষণা দিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে ঘটনাকে গণপিটুনি বলে চালিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করেছে খুনিরা। এই জোড়া খুনের ঘটনায় গতকাল ৫ মার্চ বুধবার শেষ খবর পাওয়া এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত থানায় কোন মামলা হয়নি। আর পুলিশও কাউকে গ্রেফতার কিংবা আটক করেনি।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু সাংবাদিকদের বলেন, যেহেতু ঘটনার তদন্ত চলছে সেহেতু এ মুহুর্তে কোন মন্তব্য করতে চাই না। আশা করি তদন্তে সবকিছু বের হয়ে আসবে। ঘটনার রহস্য উদঘাটন ও প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করতে পুলিশ কাজ করছে বলেও জানান তিনি। জানা গেছে, এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সেখানে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা ওইদিনের ঘটনাকে সারা দেশে চলমান মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলার ধারাবাহিকতা বলেও উল্লেখ করেন। স্থানীয় জামায়াতের পক্ষ থেকে ওই ২জনকে নিজেদের সমর্থক দাবি করে তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং এর নেপথ্যে সাবেক এক আওয়ামী ইউপি চেয়ারম্যান এবং তার ২ ভাই বলে দাবি করা হয়েছে।
গত সোমবার রাতে সাতকানিয়ার এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় কথিত গণপিটুনিতে ২জন নিহত হন। তারা হলেন- উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চনা এলাকার মাহমুদুল হকের ছেলে মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন (৪৫) ও একই ইউনিয়নের গুরগুরি এলাকার আবদুর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ ছালেক (৩৫)। জামায়াতে ইসলামীর সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের সেক্রেটারি জায়েদ হোছেন বলেন, নিহত ব্যক্তিরা জামায়াতের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। একটি সালিস বৈঠকের কথা বলে তাদের এওচিয়া এলাকায় ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ২জনের মাথায় উপর্যপুরি আঘাত করা হয়।
স্থানীয়রা জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নেজাম উদ্দিন এলাকায় আসতে পারতেন না। তাকে অসংখ্য গায়েবি মামলার আসামি করা হয়। এক পর্যায়ে তিনি বিদেশে চলে যান। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি এলাকায় ফেরেন। গত সোমবার রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে ৪ থেকে ৫টি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় নেজামসহ একদল যুবক ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় যান। সেখানে তাদের দেখে মসজিদের মাইকে এলাকায় ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। ঘোষণা শুনে লোকজন তাদের আটকের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। এ সময় লোকজনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পিটুনিতে নেজাম ও ছালেক নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন স্থানীয় ৩ বাসিন্দা ও ১ দোকানি।
আহত ব্যক্তিরা হলেন ওবায়দুল হক (২২), নাসির উদ্দিন (৩৮), আব্বাস উদ্দিন (৩৮) ও মো. মামুনুর রশিদ (৪৫। সম্প্রতি স্থানীয় এওচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নজরুল ইসলামের মাছের খামার ও ইটভাটায় লুটের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে নেজাম উদ্দিনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় নজরুলের স্ত্রী জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। নিহত ২ জনের স্বজনদের অভিযোগ- এলাকায় বিরোধ মীমাংসার জন্য একটি সালিস বৈঠকের কথা বলে নেজাম ও তার সঙ্গীদের এওচিয়ায় ডেকে নিয়ে মাইকে ডাকাত পড়েছে ঘোষণা করা হয়। এরপর নেজাম ও তার সঙ্গীদের পিটুনি দেয়া হয়েছে। এটি ছিল পরিকল্পিত হত্যা। আর এর নেপথ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক ওই ইউপি চেয়াম্যান ও তার দুই ভাই। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিক সাতকানিয়ার আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দীন নদভীর অনুসারী ছিলেন। নদভী বর্তমানে কারাগারে আছেন। আর আওয়ামী লীগের মেয়াদে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে বিতর্কিত নজরুল ইসলাম মানিক বর্তমানে আত্মগোপনে আছেন বলে জানা গেছে।
অন্য একটি সূত্রে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় আরেকটি পক্ষের মধ্যে বিরোধ চলে আসছে নেজামের। ২ পক্ষের মধ্যে অন্তত ২বার গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। প্রতিপক্ষের লোকজন নেজাম উদ্দিন ও তার সহযোগীদের ওপর হামলা করেছেন। উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা কামাল উদ্দিন বলেন, নিহত ব্যক্তিরা জামায়াতের তালিকাভুক্ত কোনো কর্মী নন। তবে সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় যেহেতু জামায়াতের জনসমর্থন বেশি, সে হিসেবে হয়তো তারাও জামায়াতকে ভালোবাসতেন। এ ঘটনা কি পরিকল্পিত, নাকি এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটেছে, তা প্রশাসন খুঁজে বের করুক। আমরা ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। এদিকে ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, ৮টি গুলির খোসা ও ১টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা জব্দ করেছে পুলিশ। মঙ্গলবার আরো অস্ত্র পাওয়ার আশায় পাশের একটি পুকুর সেচ করা হয়। তবে সেখানে কিছুই পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে ২ কর্মী খুনের ঘটনায় আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এক ইউপি চেয়ারম্যান ও তার দুই ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেছে জামায়াত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে দলটির স্থানীয় নেতারা এ অভিযোগ করেছেন। সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াতের আমীর কামাল উদ্দিন ও সেক্রেটারি মুহাম্মদ তারেক হোছাইন, কাঞ্চনা ইউনিয়নের আমীর আবু তাহের ও সেক্রেটারি জায়েদ হোসেন, এওচিয়া ইউনিয়নের আমীর আবু বক্কর ও সেক্রেটারি ফারুক হোসাইন যৌথভাবে এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন।
২জন নিহতের ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে উল্লেখ করে জামায়াতের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ ঘটনা একটি পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাকান্ড। এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা গ্রাম অনেক আগে থেকেই একটি সন্ত্রাসকবলিত এলাকা। এওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিক ছনখোলা গ্রামের পাহাড়, পাহাড়ি গাছ ও ইটভাটা নিয়ন্ত্রণে নিতে একাধিকবার সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। গ্রামের অনেক মানুষকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অসংখ্য মামলা দিয়েছে। সাধারণ মানুষের পাহাড়, ভূমি জবরদখল করেছিল। এলাকার মানুষ তার অত্যাচার-নিপীড়নে অতীষ্ঠ হয়ে তাকে বয়কট করে। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী সরকার ও প্রসাশনের সহযোগিতার কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে পারেনি।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী হাসিনার পতনের পর মানিক এলাকা ছেড়ে আত্মগোপন করলেও তার বাহিনীর ক্যাডারেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। মানিকের ভাই হারুন ও মমতাজের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ সন্ত্রাসীরা এখনো নানা অপকর্মে জড়িত। সোমবার রাতে পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামী দুঃশাসনে নির্যাতিত ব্যবসায়ী নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেককে সালিসের কথা বলে ডেকে নিয়ে মাইকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ডাকাত আখ্যা দিয়ে গণপিটুনির নামে মূলতঃ চেয়ারম্যান মানিকের নির্দেশে তার ভাই মমতাজ ও হারুনের পরিকল্পনায় কুপিয়ে ২জনকে জঘন্যতম কায়দায় হত্যা করেছে, যা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
জামায়াত নেতারা আরো বলেন, ২০১৬ সালে মানিক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে জামায়াতের কর্মী কাঞ্চনার আবুল বশরকে নির্মমভাবে ছনখোলাতে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা অবিলম্বে চিহ্নিত খুনিদের গ্রেফতার, ঘটনার গডফাদারদের বিরুদ্ধে মামলা ও বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি জানাই।ই:প্র।