অনলাইন ডেস্ক : সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দমনের কথা বলে ২০০৯ সালে ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন’ করেছিলো সদ্য নিষিদ্ধ আ’লীগ। ওই আইন দিয়ে সন্ত্রাসের লালঘোড়া দাবড়িয়েছিলো দলটি। স্বৈরাচার থেকে ফ্যাসিস্ট, ফ্যাসিস্ট থেকে ‘মাদার অব মাফিয়া’য় পরিণত করেছিলো ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে। ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে মানুষ হত্যায় মত্ত হয়েছিলো। ‘জঙ্গি’ তকমা দিয়ে শত-সহস্র আলেমকে কারারুদ্ধ করে। কথিত ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন’র প্রধান টার্গেটে পরিণত হয় ভারতীয় আধিপত্যবাদ, আওয়ামী সন্ত্রাস ও দুর্নীতির সমালোচকরা। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৩ সালের ১১ জুন কথিত ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন’র সংশোধন আইনে হাসিনা সরকার। যা কার্যতঃ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন আইনে পরিণত হয়। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা ব্যাপক গ্রেফতার ও হামলা-মামলার শিকার হন। ‘জঙ্গি’ নাটক চলে। শুরু হয় গুম-খুনের মহোৎসব। সন্ত্রাস দমনের কথিত আইনটি ছিলো হাসিনার ফ্যাসিজম কায়েম এবং ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার মৌলিক ভিত্তি। এ আইন হাসিনাকে ‘খুনি’ হওয়ার রসদ যোগান দিয়েছে। তৎকালীন আওয়ামী বিরোধী শক্তিগুলো এ আইনের অপব্যবহারের শিকার হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করে সমালোচনায় মুখর হয়েছিলো। কিন্তু কোনো সমালোচনাই হাসিনাকে তার নিষ্ঠুরতার নীতি থেকে এতটুকুন টলাতে পারেনি। যা ইচ্ছে তাই করে গেছেন তিনি। সেটির ফল হাসিনা ভোগ করছে এখন। রক্তাক্ত পথে তিনি শুধু ক্ষমতাচ্যুতই হননি, দেশ থেকেও বিতাড়িত হয়েছেন। জুলাই-আগস্টের লালপথ বেয়ে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকার এখন হাসিনা প্রণীত ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন-২০০৯’র অধিকতর সংশোধন করেছে। গত ১১ মে অধ্যাদেশের গেজেট প্রকাশিত হয়। আইনের সংশোধনী অধ্যাদেশে বেশ কিছু সংজ্ঞার মৌলিক সংযোজন রয়েছে। যা নিয়ে এখন আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে।
সরকারের তরফ থেকে এই অধ্যাদেশ সম্পর্কে বলা হয়, সন্ত্রাসী কার্র্যক্রম প্রতিরোধ এবং তাদের কার্যকর শাস্তির বিধানসহ আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে বিধান প্রণয়ন করার জন্য সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করা হয়। তাতে সরকার কোনো ব্যক্তি বা সত্তা সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে-মর্মে যুক্তিসংগত কারণের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দিয়ে ওই ব্যক্তিকে তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারে বা সত্তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা ও তফসিলে তালিকাভুক্ত করতে পারে। তবে পূর্বতন আইনে কোনো সত্তার কার্যক্রম নিষিদ্ধকরণের বিষয়ে কোনো বিধান নেই। বিষয়টি স্পষ্টীকরণসহ বিধান সংযোজন আবশ্যক হওয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-কে সময়োপযোগী করে আইনের অধিকতর সংশোধন করা প্রয়োজন। এমন প্রেক্ষাপটে সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধন করে সত্তার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, প্রয়োজনীয় বিষয় যুক্ত করা এবং অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার নিষিদ্ধ করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সরকারের এ ঘোষণার পরদিনই জারি হয় সংশোধনী অধ্যাদেশের প্রজ্ঞাপন। এতে সন্ত্রাসবিরোধী আইন’র সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘সত্তা’ বলতে কোনো আইনি প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, বাণিজ্যিক বা অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, অংশীদারি কারবার, সমবায় সমিতিসহ এক বা একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে গঠিত যেকোনো সংগঠনকে বোঝানো হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত ব্যক্তি বা সত্তার (সংগঠন) যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিধান যুক্ত করে সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করা হলো।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সব অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের যেকোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেকোনো ধরণের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকা- নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। এই অধ্যাদেশের ফলে আপাতঃ আওয়ামী তান্ডব, মিটিং-মিছিল-বক্তব্য প্রচার, দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা বিঘ্নিত হবে। কিন্তু এতে করে দেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ হবে কি না-এমন প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকরা।
ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। সন্ত্রাস বিরোধী আইন সংশোধনের অধ্যাদেশেও মানুষের ভয় পাওয়ার উপকরণ রয়েছে। আপাতঃ আইনটি আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণে প্রণিধানযোগ্য। কারণ পরদিন ১২ মে পৃথক প্রজ্ঞাপনে আওয়ামীলীগ, এর সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠন, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ফলে দু’টি পদক্ষেপই আপাতঃ আওয়ামী বিরোধী হিসেবে বাহবা কুড়াচ্ছে। ক্ষীণধারায় প্রবহমান রয়েছে কিছু সমালোচনাও। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তুমুল বিতর্ক চলছে প্রজ্ঞাপন দু’টির যথার্থতা নিয়ে।
অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী উল্টো প্রশ্ন রেখে বলেন, আমাদের দেশে সন্ত্রাস আছে নাকি ? টুইন টাওয়ারে হামলার পর আমরা জানলাম, আমাদের এখানেও নাকি সন্ত্রাস আছে। সন্ত্রাসবাদের যে সংজ্ঞা সেটি মূলতঃ স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হুমকিকে বলা হয়। যেমন ভারতের স্বাধীনতাকামী ‘উলফা’,কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী যারা সশস্ত্র সংগ্রামের পথে রয়েছেন। আমাদের দেশে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি ছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যকলাপ রয়েছে। এগুলোর জন্য ‘সন্ত্রাসবিরোধ আইন’ ঠিক আছে। অন্যথায় ব্যক্তি পর্যায়ে যে মারামারি, কাটাকাটি রয়েছে- এগুলোর জন্য প্যানাল কোড রয়েছে। কেউ যদি মৌলিক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম করে সেটিকে ‘সন্ত্রাস’ বলা যায় না। অধিকার আদায়ের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে কোনো দল, সত্তা যদি সশস্ত্র পথ বেছে নেয়- সেটিকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বলা যাবে।
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন’র যখন প্রথম হয় তখনও এটির সমালোচনা হয়েছে। সমস্যাটা হচ্ছে, আইন যখন হয় তখন অনেকে আইন বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে তারা আইনটির বেশি অপপ্রয়োগ ঘটায়। এরশাদ সরকারের সময় যখন বিশেষ ক্ষমতা আইন করা হয় তখন এটি বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো আ’লীগ-বিএনপি। কিন্তু তারা যখন ক্ষমতায় এলো তখন কিন্তু আইনটি বাতিল করেনি। বরং অপপ্রয়োগই বেশি করেছে। সন্ত্রাসী বিরোধী আইনটিও তদ্রুপ। এখন যারা সমালোচনা করছেন তারা ক্ষমতায় গেলেই যে এ আইন অপপ্রয়োগ করবে না-এমন গ্যারান্টি কে দেবে ? বাস্তবতা হচ্ছে, ক্ষমতায় আসার পর কেউ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে না।
অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও আইনজ্ঞ মো: মঈদুল ইসলামের মতে, যেকোনো আইনই অপপ্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। একেতো আইনে ফাঁক-ফোকর থাকে। দ্বিতীয়ত: যে আইনে ফাঁক নেই সেগুলোরও অপপ্রয়োগ হতে পারে। এটি নির্ভর করে আইন প্রয়োগকারী কী উদ্দেশ্যে কি প্রক্রিয়ায় আইনটি প্রয়োগ করছেন। এ কারণে প্রায়ই আমি বলে থাকি, দোষ আইনের নয়। দোষ হচ্ছে প্রয়োগকারীর। ভালো ভালো আইনের সদ্ব্যবহার হচ্ছে এ কথা বলা যাবে না। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকান্ডের মামলাগুলোর কথাই ধরুন। এসব মামলা দায়েরে আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে এটা বলা যাবে না।
‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন সংশোধী-২০২৫’ অধ্যাদেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মূল আইন এবং পূর্বতন সংশোধনীগুলোতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিধান ছিলো। অর্থাৎ দলের কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পৃথক সুযোগ ছিলো না। দল নিষিদ্ধ করা হলে দলের কার্যক্রম এমনিতেই নিষিদ্ধ হয়ে যেতো। কিন্তু এবারের সংশোধনীতে দলের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করার বিধান সংযোজন করা হয়েছে। যে কারণগুলোর কথা বলা হচ্ছে সেটি আমার কাছে স্পষ্ট মনে হচ্ছে না।
ফৌজদারি আইনে অভিজ্ঞ সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান সংশয় প্রকাশ করে বলেন, দেশে এখনো সন্ত্রাস বিরাজমান। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা আপাতঃ আত্মগোপন কিংবা পালিয়ে গেলেও অন্য অনেকে আবির্ভূত হয়েছে সন্ত্রাসী হিসেবে। জমি দখল, বাড়ি দখল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল হচ্ছে। বহু মানুূষ ব্যক্তিগতভাবে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের শিকার। নিত্য নতুন তকমা দিয়ে বহু নিরীহ মানুষের ওপর সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। নব্য সন্ত্রাসকে নিছক ‘আওয়ামী সন্ত্রাস’ আখ্যা দিয়ে বৈধতা দেয়া যাবে না। একটি গ্রুপ গা ঢাকা দিয়েছে। অন্য গ্রুপ স্থান দখল করেছে। সাধারণ মানুষ তাহলে সন্ত্রাস বিরোধী আইনের কি সুফল পাবে ? সন্ত্রাসতো দূর হয়নি। ব্যক্তি পরিবর্তন হয়েছে। আইন যদি ব্যক্তি মানুষের জান-মাল-সম্ভ্রম সুরক্ষায় কাজে না আসে সেই আইন কোনোভাবেই যথার্থ হতে পারে না। আইনকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ারে পরিণত করেছিলো আওয়ামীলীগ। সেটির ফল তারা পেয়েছে। সর্বশেষ সংশোধনী যদি একই উদ্দেশ্যে (প্রতিপক্ষ দমন) করা হয়, সেটিও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। সন্ত্রাস দমন আইন যদি প্রকৃত সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে না পারে, কোনো সংশোধনীতেই কাজ হবে না-বলে মনে করেন এ আইনজ্ঞ।ই