সড়ক-মহাসড়কেও পশুর হাট

রাজধানীতে শর্ত ভাঙছে ইজারাদাররা : রাস্তা বন্ধ মানুষের ভোগান্তি : দেখার যেন কেউ নেই

অনলাইন ডেস্ক : ঈদের চারদিন আগে থেকে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে কোরবানির পশার হাট বসার কথা। হাটে ইজারার শর্তে সে কথাই উল্লেখ আছে। সে হিসাবে গতকাল মঙ্গলবার থেকে হাট শুরু হওয়ার কথা ছিল। একই সাথে হাট সংলগ্ন এলাকায় কোনোভাবে মহাসড়ক, প্রধান সড়ক, অলি-গলিসহ কোনো সড়ক বন্ধ বা মানুষ ও যানবাহন চলাচলে বাধা দেয়া যাবে না। অথচ ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে মহাসড়ক, সড়ক এমনকি এলাকার অলি-গলি দখল করে আরও ৪/৫ দিন আগে থেকে বসানো হয়েছে কোরবানির পশুর হাট। কোনো কোনো এলাকায় প্রধান সড়ক যান চলাচলের জন্য ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এলাকার গলিপথও। এতে করে মানুষকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছ। এমনকি রোগি নিয়ে হাসপাতাল যাওয়ার সড়ক ও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে করে বৃদ্ধ, প্রসূতিসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, কোনো কোনো এলাকায় ইজারা ছাড়াই বসেছে কোরবানির হাট। আবাসিক ভবনের গেটেও গরু বাঁধা হয়েছে। এসব অনিয়ম দেখার যেন কেউ নেই। ভাগান্তি নিয়ে কার কাছে অভিযোগ করবে সে বিষয়টাও বেশিরভাগ মানুষের জানা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের ঈদুল আজহায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার ১১টি স্থানে অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) চার দফায় ১৪টি হাটের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়। এর মধ্যে ডিএসসিসির আফতাবনগর ও মেরাদিয়ার পশুর হাট এবং ডিএনসিসির বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিং ও বনরূপা আবাসিক এলাকার হাট জনবহুল স্থানে হওয়ায় আদালত বাতিল করে দিয়েছেন। শ্যামপুরের হাটটি শেষ মুহূর্তে এসে ইজারাদারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্থগিত করে করপোরেশন। কমলাপুর ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব সংলগ্ন হাট আর ধোলাইখালের হাটটি সরকারি মূল্যের চেয়ে কম হওয়ায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এখনো হাট বসানোর অনুমতি আসেনি। এদিকে পশুর হাট আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার এক দিন বাকি থাকলেও গত রোববার মেরুল বাড্ডা কাঁচাবাজার, বালুর মাঠ ইকরা মাদ্রাসার পাশের খালি জায়গা ও মিরপুর কালসি খালি জায়গার হাটের দর উন্মুক্ত হয়েছে। এখনো বাকি যাচাই-বাছাই আর কার্যাদেশ দেওয়া। এ ছাড়া দুই সিটিতে মিরপুরের গাবতলী ও ডেমরার সারুলিয়ায় দুটি স্থায়ী পশুর হাট আছে। শনিরআখড়ায় দনিয়া কলেজ মাঠের নামে হাটের ইজারা দেয়া হলেও বাস্তবে দনিয়া কলেজে হাট বসানোর মতো কোনা জায়গা নেই। পুরো হাটই বসেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এবং পাড়া মহলল্লার ভিতরে। ইজারার নির্ধারিত জায়গা ছাড়িয়ে বেশিরভাগ হাট মহাসড়ক, আবাসিক এলাকা আর খেলার মাঠেও স্থান নিয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার থেকে হাটে বেচাবিক্রির শর্ত থাকলেও আগেই শুরু হয়েছে বেচাবিক্রি।
সরেজমিন দেখা যায়, ডিএনসিসির ভাটুলিয়া সাহেব আলী মাদ্রাসা হতে ১০ নম্বর সেক্টর রানাভোলা অ্যাভিনিউ সংলগ্ন উত্তরা রানাভোলা সুইচগেট পর্যন্ত হাটের বিজ্ঞপ্তি দিলেও এখানে পশুর হাট বসেনি। হাট বসেছে ঢাকা-আশুলিয়া সড়কের পাশে তুরাগ নদীর পাশে বেড়িবাঁধ আর আইইউবিএটি ক্যাম্পাসের পাশে। মোহাম্মদপুরের বছিলায় ৪০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন খালি জায়গার হাটটি আশপাশের সড়কে গিয়ে ঠেকেছে। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সংলগ্ন খালি জায়গায় হাট বসার কথা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ থাকলেও হাট বসানো হয়েছে খেলার মাঠে। মিরপুর ইস্টার্ন হাউজিং এলাকার খালি জায়গা ছেড়েও পল্লবী পর্যন্ত হাট বসানো হয়েছে। খিলক্ষেত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচের হাটটিও নির্ধারিত জায়গা ছাড়িয়ে গেছে। মস্তুলের হাটটিরও একই অবস্থা। উত্তরার দিয়া বাড়ির ১৬ ও ১৮ নম্বর সেক্টরের বউ বাজার সংলগ্ন হাটটিও নির্ধারিত জায়গার বাইরে বসানো হয়েছে।
ডিএসসিসির উত্তর শাহজাহানপুর মৈত্রী সংঘের খালি জায়গার হাটটি রেলওয়ে খেলার মাঠে বসানো হয়েছে। পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের পশ্চিম পাশের নদীর পাড়ের হাটটি পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত ছাড়িয়ে গেছে। দনিয়া কলেজের হাটটি শনির আখড়া পর্যন্ত মহাসড়কের দুপাশে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত বসানো হয়েছে। মহাসড়ক ছাড়িয়ে এই হাট পাড়া-মহল্লার ভিতরেও ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে দনিয়া হয়ে পাটেরবাগ, মুরাদপুর, জুরাইন যাওয়ার প্রধান সগকটিও গত ৪/৫ দিন আগের বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে করে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা থেকে উল্লেখিত এলাকায় যেতে হলে যাত্রাবাড়ী হয়ে ধোলাইপাড় ঘুরে আসতে হবে। এখানেও বিপত্তি দনিয়া গোয়ালবাড়ি মোড় থেকে রাস্তা বাঁশ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে করে এই অঞ্চলের ৫/৬ লাখ মানুষ এখন পুরোপুরি জিম্মি। এমনকি কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে জরুরিভিত্তিতে হাসপাতাল নেয়াও কোনো সুযোগ রাখা হয় নি। গত সোমবারও দেখা গেছে একটা এ্যাম্বুলের দনিয়া এলাকায় প্রবেশ করানোর জন্য এক যুবক বার বার অনুরোধ করলেও হাটের স্বেচ্ছাসেবকদের মন গলেনি। তারা বলেছে, ধোলাইপাড় দিয়ে ঘুরে যেতে হবে। ওই যুবক বার বার অনুরোধ করে বলছিলেন, ভাই আমার বাবার গুরুতর অসুস্থ, তাকে জরুরিভিত্তিতে হাসপাতলে না নিলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাতেও স্বেচ্ছাসেবকদের মন গলেনি। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ ঘুরে ধেলাইপাড় হয়ে যাওয়ার জন্য রওনা দেন। গলিপথগুলোতে গরু বাঁধার কারণে লোকজনের চলাচলে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালেও শনিরআখড়া বাজারের রাস্তায় একটি মুদি দোকানের সামনে গরু বাঁধায় ওই দোকানদারকে বিলাপ করতে দেখা গেছে। পরে স্থানীয় কয়েকজন এসে সেই দোকানের সামনে থেকে গরু সরাতে বাধ্য করে পাইকারকে।
সাদেক হোসেন খোকা মাঠের দক্ষিণ পাশের খালি জায়গা ও ধোলাইখাল ট্রাক স্ট্যান্ডের হাটটি রায়সাহেব বাজার মোড় হতে দয়াগঞ্জ মোড় পর্যন্ত একদিকে, আরেকদিকে মুরগিটোলা থেকে লোহারপুল পর্যন্ত মহাসড়কের দুপাশে হাট ছাড়িয়ে গেছে। রহমতগঞ্জ ক্লাবের খালি জায়গার হাটটিও সড়ক আর খেলার মাঠে বসানো হয়েছে। ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজের পূর্ব পাশের হাটটি বেড়িবাঁধ এলাকার দুই-তিন কিলোমিটার জুড়ে বসানো হয়েছে। ইসলামবাগ ও হাজারীবাগে আবাসিক ভবনের সামনেও গরু বেঁধে রাখা হয়েছে। সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারের পাশে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব সংলগ্ন খালি জায়গায় হাটের স্থান নির্ধারিত হলেও হাটটি বালুর মাঠ ও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠেও বসানো হয়েছে। এ ছাড়া ধলপুর সিটি পল্লি মাঠ ও আশপাশের এলাকায়ও হাট বসানো হয়েছে। আমুলিয়া আলীগড় মডেল কলেজের উত্তর পাশের খালি জায়গার হাটটিও কলেজ মাঠসহ আশপাশের এলাকায় বসানো হয়েছে। পথচারী ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, হাট যেন তাদের জীবনে এক আতঙ্কের নাম। গরু, ট্রাক, মাইকিং, ময়লা, দুর্গন্ধ—-সব মিলিয়ে এক অসহনীয় পরিবেশ। রায়েরবাগ এলাকার বাসিন্দা হোসেন আলী বলেন, দনিয়া কলেজ মাঠে হাটের অনুমতি দেওয়া হলেও গরু চলে এসেছে ৩ কিলোমিটার ভেতরে রায়েরবাগ পর্যন্ত। অলিগলি পর্যন্ত গরু। আমরা কোথায় যাব? কীভাবে চলব?
শনির আখড়ার বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন বলেন, রাস্তায় গরু দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। মাইকে সারা দিন বিক্রি-বিক্রির চিৎকার। ঘরে বয়স্ক মানুষ, শিশুরাতো আছে। আরক’দিন পরেই এইচ এসসি পরীক্ষা। এমন পরিবেশে থাকা দায় হয়ে উঠেছে।
এর বাইরে দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ইজারা ছাড়াও অবৈধ গরুর হাট বসানো হয়েছে। কলাবাগান কলোনির মাঠে স্থানীয় বিএনপি আর এনসিপির নেতাকর্মীরা আরেকটি অবৈধ হাট বসিয়েছেন। হাতিরঝিল ঘেঁষে বাংলামটরে আরেকটি অবৈধ গরুর হাট বসছে। শ্যামপুরে শেষ মুহূর্তে প্রস্তুতির স্বল্পতা দেখিয়ে হাটের ইজারা নিতে অপরাগতা প্রকাশ করলেও সেখানে অবৈধ হাট বসানো হচ্ছে। বনশ্রী আর মেরাদিয়া এলাকায়ও চলছে অবৈধ হাটের প্রস্তুতি। এ ছাড়া মিরপুরের কাজীপাড়া বসুন্ধরা গলির পাশে আরেকটি পশুর হাট বসানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, নগরের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় হাট ব্যবস্থাপনায় কঠোরতা জরুরি। প্রতি বছর একই বিশৃঙ্খলা দেখছি, অথচ কার্যকর পদক্ষেপ নেই। এর পেছনে রয়েছে দুর্বল প্রশাসনিক সমন্বয়, রাজনৈতিক চাপ এবং ব্যবসায়িক স্বার্থ। হাট ইজারা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা না থাকলে কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। আবার যাদের ইজারা দেওয়া হয়, তারা নির্ধারিত নিয়ম মানে না।
তিনি বলেন, কিছু রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী নিয়ম অমান্য করে আগেই হাট বসিয়ে দেন। পরে প্রশাসন বাধ্য হয় বিষয়টি মেনে নিতে। এতে করে আইনের শাসন বিঘিœত হয়। ডিএসসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা হাসিবা খান বলেন, ইজারাদারদের হাট বসানোর জায়গা নির্ধারণ করে শর্তজুড়ে দেওয়া হয়েছে। এরপরও যে হাটগুলোর বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট ও আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।ই

মন্তব্য করুন