সাতকানিয়ার ১কিশোরগ্যাং সদস্যর ছবি।
খবর ডেস্ক:
ব্রাউন চুল। চুলের কাটও ভিন্ন। হাতে-শরীরে ট্যাটু। কানের লতিতে রিং ঝুলছে। জামা-কাপড়ের ডিজাইনেও ভিন্নতা। লেখাপড়া সর্বোচ্চ প্রাইমারির গণ্ডি। হাতে দামি মোবাইল ফোন ও মুখে সিগারেট নিয়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীর আসা-যাওয়ার রাস্তায় আড্ডা। নারী শিক্ষার্থী দেখলেই নানা ভঙ্গিতে ইশারা দিয়ে টিজ। সন্ধ্যা হলে চুরি, ছিনতাই, আধিপত্য বিস্তার, আতঙ্ক তৈরি, মারামারি, খুনোখুনিতে। অনেক সময় অবস্থান জানান দিতে গভীর রাত পর্যন্ত অস্ত্রের মহড়া।
মাদক সেবন ও বিক্রিতে সম্পৃক্ততা। থানা পুলিশের খাতায় অপরাধী হিসেবে নাম উঠেছে বহু আগেই। কেউ কেউ ধরা খেয়ে জেল কেটেছে অনেকবার। তারা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। প্রত্যকেই কোনো না কোনো বড় ভাইয়ের গ্রুপে। শেল্টার দেন ওই বড় ভাই। আবার বড় ভাইকেও শেল্টার দেন অন্য কেউ।
মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা রাকিবুল। বয়স ১৮ হয়নি এখনো। পরিবারের সঙ্গে থাকে রাজধানীর গোড়ানে। বাবা-মা ছাড়াও ছোট ১ বোন আছে। বাবা গাড়ি চালান। লেখাপড়া করেছে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। ইংরেজি-গণিতে ভীতি থাকায় স্কুলের প্রাইমারির গণ্ডি পার হওয়া সম্ভব হয়নি। তারপর থেকে এলাকার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে চলাফেরা শুরু হয়। বন্ধুরাও লেখাপড়া বাদ দিয়েছে অনেক আগেই। কাজকর্ম না থাকায় সবাই মিলে গভীর রাত পর্যন্ত এলাকার অলিগলিতে আড্ডা দেয়। সিগারেট চায়ের পাশাপাশি একসময় তাদের আড্ডায় যুক্ত হয় গাঁজা-ইয়াবা। বন্ধুদের সঙ্গে এলাকার বিভিন্ন স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নারী শিক্ষার্থী দেখলেই তাকে টিজ করে। বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে কু-প্রস্তাবও দেয়। এতে করে অনেক শিক্ষার্থী ও তার অভিভাবকরা বিচার দিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আবার সেই আগের মতো নারী শিক্ষার্থীদের উত্ত্যক্ত করে। ধীরে ধীরে তাদের আড্ডায় বন্ধুর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এক বন্ধুর মাধ্যমেই রাকিব নাম খেলায় কিশোর গ্যাং গ্রুপ উজ্জ্বলের গ্রুপে। উজ্জ্বল সিনিয়র বড় ভাই। অনেক বছর ধরেই এই গ্রুপের নিয়ন্ত্রক। তার গ্রুপের সদস্য সংখ্যা অর্ধশতাধিক। সবারই বয়স ১৫ থেকে ২০ এর মধ্যে। রামপুরা, খিলগাঁও এলাকার অনেক নেতার হয়ে উজ্জ্বল কাজ করে। আর তার কাজে সহযোগিতা করেন এসব কিশোররা। উজ্জ্বলের নামে বিভিন্ন অপরাধের কয়েকটি মামলা আছে।
রাকিব সংবাদকর্মীকে বলে, কিশোর গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ার পর এখন মনে হচ্ছে আমার জীবনটা আরও সুন্দর হতে পারতো। আমার বয়সী অনেকেই স্কুলের ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যায়। তারা কতো পরিপাটি করে থাকে। সবাই তাদের আদর ভালোবাসা দেয়। কিন্তু আমার মতো যারা গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়েছে তাদেরকে কেউ পছন্দ করে না। ধরা পড়ার ভয় নিয়েও এখন পকেটে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ঘুরতে হয়। বড় ভাইদের মাদক বিক্রিতে সহযোগিতা করতে হয়। অনেক ক্রেতার বাসা বাড়িতে মাদক পৌঁছে দেই। বিনিময়ে আমাকে কিছু টাকা দেয়া হয়।
সাফায়াতের বাবা ভ্যানগাড়ি চালক। আর সে অটোরিকশা চালায়। ১৭ বছর বয়সী এই কিশোরের বাড়ি মাদারীপুরে হলেও ঢাকার মাদারটেক এলাকায় বাবা, মা ও বড় বোনের সঙ্গে বসবাস। অভাবের সংসারে অর্থের জোগান দিতে সে রিকশা চালানো শুরু করে। এর আগে সে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। কিন্তু সংসারে টানাটানি থাকায় তাকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। তাই রিকশা চালিয়ে জমা খরচ দিয়ে দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা রোজগার হতো। তবে এর বাইরেও সাফায়াতের একটা ভিন্ন জগৎ আছে। রিকশা চালানো তার পেশা হলেও পেশার সুবাদে তার ঘরের বাইরে যেতে হতো প্রতিদিন। এই গলি থেকে ওই গলি। এপাড়া থেকে ওপাড়ায় যেতে যেতে সমবয়সী অনেকের সঙ্গেই তার পরিচয় হয়ে যায়। সময় গড়াতে তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। দেখা হলেই তারা আড্ডা দিতো, চা, সিগারেট খেতো। এক সময় রিকশা চালানোর প্রতি তার অমনোযোগ চলে আসে। সাফায়াত বলে, রিকশা নিয়ে বের হলেই ইনকাম হতো। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে মিশে আড্ডা দিয়ে অন্য এক জগতে চলে যাই। তাদের সঙ্গে উজ্জ্বল নামের ১ বড় ভাইয়ের কাছে যেতাম। সেখানে আমার মতো আরও অনেকেই যাওয়া আসা করতো। তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। অনেক সময় তাড়াতাড়ি রিকশা বন্ধ করে সন্ধ্যার পরপরই তাদের কাছে চলে যাই। সিগারেট, গাঁজা থেকে শুরু করে ইয়াবা, ফেনসিডিলের মতো মাদক সেবন করি। পাশাপাশি বড় ভাইয়ের নির্দেশে বিভিন্ন কাজে যাই। প্রথম প্রথম বন্ধুদের পাল্লায় পড়েই যেতাম। কিন্তু এখন আড্ডা দেয়া, মাদক সেবন নেশার মতো হয়ে গেছে। অসুস্থ থাকলেও আড্ডায় চলে যাই। গ্রুপের অন্য ছেলেদের মতো করে চুল কাটা, চলাফেরা, ট্যাটু আঁকা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়াসহ সব চালচলন বদলে গেছে। এলাকায় তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মারামারি করি। আমাদের গ্রুপের ছেলেদের নিয়ে কেউ বাজে মন্তব্য করলে তাকে আমরা সবাই মিলে শায়েস্তা করি। বিভিন্ন স্কুলের মেয়েদের আসা-যাওয়ার রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখ ইশারা দেই। তাদের ফেসবুক আইডি পেলে খুঁজে রিকুয়েস্ট পাঠাই, মেসেজ দেই। মোবাইল নম্বর পেলেও কল দিয়ে কথা বলি। এলাকার অলিগলিতে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করি। সাফায়াত আরও বলে, আমি মূলত উজ্জ্বল গ্রুপের হয়ে কাজ করি। গ্রুপ লিডার যেরকম বলেন আমরা সেভাবেই কাজ করি। রামপুরা, খিলগাঁও থানা এলাকায় এই গ্রুপ একটা আতঙ্কের নাম। অনেকবার পুলিশ ও ডিবি আমাদের গ্রুপের অনেককে ধরে নিয়ে গেছে। ছাড়া পেয়ে আমরা আবারো একই কাজ করেছি।
কিশোর গ্যাং সদস্য আরমানের বাবা সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেন আর সে গাড়ির এসির কাজ করে। একটা সময় এটাই ছিল তার মূল পেশা। দিনরাত এই কাজ করেই পরিবারে বাবার সঙ্গে অর্থের জোগান দিতো। তবে এই কাজ এখন সে মন চাইলে করে। কারণ আরমানের জীবন চাকা বহু আগেই উল্টোপথে যাওয়া শুরু করেছে। ছোটবেলা স্কুলে কয়েক বছর অনিয়মিতভাবে যাওয়া-আসা করেছিল। একসময় সেটিও বন্ধ হয়ে যায়। প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীন সময়েই সিগারেট খাওয়ার হাতেখড়ি হয়। তার মতোই আরও কিছু বন্ধুর পাল্লায় পড়ে স্কুল ফাঁকি দিয়ে তারা আড্ডা দিতো, সিগারেট খেতো। আরমান বলেন, আমার জন্ম ঢাকায়। খিলগাঁও, শান্তিপুর, তিলপাপাড়া, সবুজবাগ এলাকায় আমি বড় হয়েছি। বাবা বিভিন্ন ভবনের সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেন। লেখাপড়া না করায় বাবা চেয়েছিলেন কোনো একটা কাজ শিখি। বাবার কথামতো গাড়ির এসির কাজ শিখেছিলাম। কয়েক বছরের মাথায় এসির পুরো কাজই প্রায় শিখে ফেলি। কিন্তু যেসব দোকানে কাজ করতাম সেখানে পুরো কাজ করার পরেও মূল্যায়ন করতো না। বয়সে ছোট ছিলাম বলে বেতনও কম দিতো। এজন্য এই কাজে মন টিকেনি। অনিয়মিতভাবে দোকানে যাওয়া-আসা করতাম। মালিক যা দিতো সেটা দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। সন্ধ্যার পরে প্রায়ই আশেপাশের কয়েকটি এলাকার কিশোর বয়সী ছেলেরা একসঙ্গে হয়ে আড্ডা দিতাম। সেই আড্ডা থেকে গাঁজা সেবন শিখি। সবাই যা করতো আমিও তাই করতাম। আমরা ছাড়া বিভিন্ন বয়সের ছেলেরা এলাকার বিভিন্ন স্থানে গ্রুপ বেঁধে আড্ডা দেয়। তবে আমরা সিনিয়র-জুনিয়র মেনে চলি। সিনিয়রদের সামনে সিগারেট খাই না। তবে আমাদের সবার সিনিয়র উজ্জ্বল ভাই। আমরা সবাই তার গ্রুপের সদস্য। তার গ্রুপের সবার চুলের কাটিং একই। আমরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ছোট ছোট চায়ের দোকান, সবজি ব্যবসায়ী, ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করি। অনেক সময় নির্জন রাস্তায় পথচারী পেলে ছুরি দেখিয়ে সব ছিনতাই করে নেই। এলাকায় আমরা প্রায়ই আতঙ্ক সৃষ্টি করতে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেই। আমরা মাদক বিক্রির সঙ্গে জড়িত। আরমান বলে, কীভাবে যে এই পথে চলে এলাম সেটি নিজেও বুঝতে পারছি না। হয়তো আমাদের পরিবার বস্তিতে থাকে, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় তাই এ পথে চলে আসছি। কিন্তু এখন অনেক ধনী ঘরের ছেলেরাও আমাদের গ্রুপের সদস্য। স্কুল ফাঁকি দিয়ে নেশা করে। মারধর, ইভটিজিংয়ের সঙ্গে জড়িত।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, রামপুরা-খিলগাঁও এলাকায় উজ্জ্বল গ্রুপের সদস্যরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ পেয়েছি। আমরা ইতিমধ্যে অনেককে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠিয়েছি। আবার যারা উঠতি বয়সী এবং অপরাধে জড়ানোর প্রাথমিক পর্যায়ে আছে তাদেরকেও ধরে এনে অভিভাবক ডেকে মুচলেকা দিয়ে জিম্মায় দিয়েছি। আর উজ্জ্বলের বিষয়ে আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি। তাকেও আইনের আওতায় আনা হবে। তাদের সঙ্গে ওই এলাকার আর কে কে জড়িত এ বিষয়ে জানার চেষ্টা চলছে।