আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসিফ মাহমুদের সাক্ষ্য
অনলাইন ডেস্ক : কোটা সংস্কারবিরোধী আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা করে ভিডিও বার্তা না দিলে পুশ করা হতো ইনজেকশন। চব্বিশের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার সাক্ষ্যে এমন তথ্য দেন স্থানীয় সরকার, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া। বিচারপতি মো: গোলাম মর্তুজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনি এ সাক্ষ্য দেন। রাজধানীর চানখাঁ’র পুলে শহীদ আনাসহ ৬ জনকে হত্যা মামলায় গতকাল বৃহস্পতিবার সাক্ষ্য দেন তিনি। সাক্ষ্যে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া বলেন, ১৯ জুলাই ২০২৪। দেশজুড়ে বন্ধ ইন্টারনেট সেবা। এদিন রাতেই তাকে (আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া) তুলে নেন সাদা পোশাকধারীরা। মাথায় কালো টুপি পরিয়ে মাইক্রোবাসে তাকে নিয়ে যান ডিবি পরিচয়ে আসা কিছু লোক। রাখা হয় আয়নাঘরে। আর সেখানেই জুলাই আন্দোলন প্রত্যাহারে ভিডিও বার্তা দিতে চাপ দেয়া হয়। কিন্তু রাজি না হলে ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করে ফেলা হয়।
গতকাল বেলা ২টা ৫০ মিনিটে বিচারপতি মো: গোলাম মর্তুজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল বসেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন, মো: শফিউল আলম মাহমুদ এবং মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এর পর সাক্ষীর ডায়াসে ওঠেন আসিফ মাহমুদ। ‘যাহা বলিবো সত্য বলিবো. সত্য বৈ মিথ্যা বলিবো না’ মর্মে শপথবাক্য পাঠ করে প্রথমে তিনি তার নিজের পরিচয় দেন। পরে একে একে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পুরো বিবরণ তুলে ধরেন। সাক্ষ্য শেষে এসব হত্যা বা নৃশংস ঘটনার জন্য আসামিদের বিচার চান।
সাক্ষ্যে আসিফ বলেন, আমি ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক ছিলাম। সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা সংস্কারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলছিল। ২০১৮ সালে এ আন্দোলন ব্যাপক মাত্রায় দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলশ্রুতিতে চাপে পড়ে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটাপ্রথা পুরোপুরি বাতিল করতে বাধ্য হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। ২০১৮ সালের আন্দোলনেও আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলাম।
তিনি বলেন, কোটা বাতিলের ওই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট হয়। ২০২৪ সালের ৫ জুন কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনটি অবৈধ ঘোষণা করে কোটাপ্রথা পুনর্বহাল করেন হাইকোর্ট বিভাগ। এই রায়ের প্রতিবাদে আমরা তাৎক্ষণিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ-মিছিল করি। এরপর কোরবানির ঈদের ছুটি হয়ে যায়। আমরা কোরবানির ঈদের পর ওই বছরের ১ জুলাই থেকে পুনরায় আন্দোলন শুরু করি।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জেলা শহর পর্যায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলতে থাকে। ১৪ জুলাই আমরা প্রেসিডেন্ট বরাবর স্মারকলিপি দিই। সেদিন সন্ধ্যায় একটি সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। এর প্রতিবাদে ওই দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলসহ বিভিন্ন হলের ছাত্র-ছাত্রীরা হলের গেটের তালা ভেঙ্গে রাজু ভাস্কর্যের সামনে একত্রিত হন। সেখানে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীরা ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার-স্বৈরাচার’ ইত্যাদি সেøাগান দিতে থাকেন। তখন থেকে আন্দোলনে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত হয়।
পরদিন ১৫ জুলাই আন্দোলন দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট বলে উস্কানি দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার এ বক্তব্যের পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগসহ বহিরাগতরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের হামলায় শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী গুরুতর রক্তাক্ত আহত হন। তাদের মধ্যে ছাত্রীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ছিল। আহত ছাত্র-ছাত্রীরা চিকিৎসার জন্য গেলে ঢাকা মেডিকেলেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া বলেন, এ হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই সারাদেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়। ওইদিন শহীদ মিনারে আন্দোলনরত অবস্থায় আমরা জানতে পারি পুলিশের গুলিতে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আবু সাঈদ শাহাদাত বরণ করেছেন। পরে জানতে পারি ওইদিন চট্টগ্রামের ওয়াসিমসহ সারাদেশে ৬ জন আন্দোলনকারী শহীদ হন। ১৭ জুলাই এসব হত্যাকা-ের প্রতিবাদে কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালন করি। তখন আর এ আন্দোলন শুধুমাত্র কোটা সংস্কার দাবিতে সীমাবদ্ধ ছিলো না। রাজু ভাস্কর্যে গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালনের আগেই আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পুলিশ। সেখান থেকে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনসহ দু’জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সংঘর্ষ এড়াতে আমরা ভিসি চত্বরে গায়েবানা জানাজা পালন করি। জানাজা শেষে কফিন মিছিল বের করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর দিকের হলপাড়ার দিকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ি। সেদিন সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদসহ শতাধিক আন্দোলনকারী পুলিশের হামলায় আহত হন। ওই দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
সাক্ষ্যে তিনি বলেন, এরপর আমরা জাতীয়ভাবে কর্মসূচি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিই। ১৮ জুলাই সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করি। সেদিন দেশব্যাপী পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক গুলিবর্ষণ করেন। এতে সারাদেশে কমপক্ষে ২৯ জন আন্দোলনকারী নিহত হওয়ার খবর পাই আমরা। এ পর্যায়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। আমরা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখি। ওইদিন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুড়িয়ে দিয়ে দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানো হয়। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বহু মিথ্যা মামলা করা হয়। একইসঙ্গে ব্লক রেইড দিয়ে ব্যাপক মাত্রায় ধরপাকড় শুরু করা হয়। সেদিন রাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার।
এই সাক্ষী বলেন, ১৯ জুলাই আমাদের কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালিত হয়। এদিন আন্দোলনকারীদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়। এছাড়া আন্দোলন দমনে ব্যাপক মাত্রায় নির্বিচারে গুলি করা হয়। ফলে সেদিন সারাদেশে শতাধিক শহীদ হওয়ার খবর পাই। ওই দিন রাতে ঢাকার গুলশান নিকেতন এলাকা থেকে একটি মাইক্রোবাসে ডিবি পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী কিছু লোকজন আমাকে মাথায় কালো টুপি পরিয়ে তুলে নিয়ে যান। ওই রাতে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকেও তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে আন্দোলন প্রত্যাহারে একটি ভিডিও বার্তা দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। আমি রাজি না হলে আমাকে ইনজেকশন পুশ করে অজ্ঞান করে ফেলা হয়। ২৪ জুলাই সকালে আমাকে নিকেতনস্থ সেই স্থানে রেখে যাওয়া হয়। আমাকে তুলে নিয়ে যে রুমে রাখা হয়েছিল তা ৫ আগস্ট পরবর্তীকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে বুঝতে পারি যে এটি সেই জায়গা।
ছাড়া পেয়ে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য ভর্তি হন আসিফ মাহমুদ। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামও একই হাসপাতালে ভর্তি হন। তারা হাসপাতালে তাদের নজরদারিতে রাখেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। এমনকি মোবাইল ফোনও কেড়ে নেয়া হয়। বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় যোগাযোগও।
গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়ার সাক্ষ্য গ্রহণ চলে। তবে শেষ না হওয়ায় অবশিষ্ট সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ১৬ অক্টোবর পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন।
গতকাল ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম ও গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, মঈনুল করিম, আবদুস সাত্তার পালোয়ান, সহিদুল ইসলাম, মামুনুর রশীদসহ অন্যরা। আসামিপক্ষ ও স্টেট ডিফেন্স আইনজীবীরাও উপস্থিত ছিলেন।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে রাজধানীর চানখারপুলে ৬ জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে দশম দিনের মতো সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য ছিল গতকাল। সাক্ষ্য গ্রহণকালে গ্রেফতার হওয়া আসামিদের হাজির করা হয়।ই