ডেস্ক : দীর্ঘ একদলীয় শাসনের ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমান্বয়ে রাজনীতিকীকরণ হয়েছে, যা দেশের নিরাপত্তা খাতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে বলে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার (ওএইচসিএইচআর) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
জেনেভা থেকে প্রকাশিত জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ বছরের একটানা শাসনের ফলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর প্রভাব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ওপরও পড়েছে। বিশেষ করে, পুলিশের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
ওএইচসিএইচআরের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ডিজিএফআই, এনএসআই ও পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) উচ্চ পর্যায়ের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর রাজনৈতিক সংযোগ ও তাদের পরিবারের রাজনৈতিক পটভূমি যাচাই করত। এমনকি, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ অনুমোদন করতেন এবং রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোর নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হতো।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, শুধু পুলিশ নয়, সামরিক বাহিনীতেও দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া হতো। যারা অনুগত নয় বলে বিবেচিত হতেন, তাদের পদোন্নতি আটকে দেওয়া হতো, দূরবর্তী স্থানে বদলি করা হতো কিংবা পদত্যাগে বাধ্য করা হতো। ফলে, নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর ভেতরে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি নির্ভরশীলতার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে গুরুতর অপরাধের দায়মুক্তির বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ২৫৯৭টি কথিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং ৭০৮টি গুমের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে বলে নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলোর তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু র্যাবের হাতেই ৮০০টির বেশি কথিত হত্যা এবং ২২০টির বেশি গুমের ঘটনা ঘটেছে। তবে বিচার হয়েছে মাত্র একটি মামলায়, যেখানে ভুক্তভোগী ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের এক স্থানীয় নেতা।
এছাড়া, জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি জানিয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নির্যাতন ও ঘুষ আদায়ের চর্চা ব্যাপকভাবে চলে আসছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘নির্যাতন ও নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু (নিষিদ্ধকরণ) আইন’ প্রণয়ন করলেও বাস্তবে আইনটি কার্যকর হয়নি। গত এক দশকে অন্তত ১০৩ জন বন্দি নির্যাতনে প্রাণ হারালেও মাত্র ২৪টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে এবং এর মধ্যে মাত্র একটিতে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর রাজনৈতিক প্রভাবের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা না গেলে ভবিষ্যতে নিরাপত্তা খাতের কার্যকারিতা আরও হুমকির মুখে পড়তে পারে। এজন্য আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশ সরকারকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমিয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।ই