পুলিশে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
অনলাইন ডেস্ক : আন্তবর্তীকালিন সরকারের সময় পুলিশের চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার জোর উদ্যোগ নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। পুলিশ বাহিনীতে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজিপিসহ (প্রশাসন) ১৯টি অতিরিক্ত আইজিপির পদ এখনও শূণ্য। গত ১৭ বছর ধরে বঞ্চিত ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদের পেশাদার ও সৎ কর্মকর্তারা এ সরকারের প্রায় ছয় মাসেও যথাসময়ে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। পুলিশের এসএসবি না হওয়ায় চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে পুরো পুলিশ বাহিনীতে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ছাত্র-জনতার হত্যার সাথে জড়িত পুলিশ, র্যাব ও আনসারের যে সব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনিদিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে, তারাও ধরাছোয়ার বাইরে। এ সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহন না করে পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর পোশাকে পরিবর্তন আনার বিষয়টি কতটুকু সময়োযোগী তা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা অনেক কম। একই সাথে যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবও রয়েছে পুলিশ বাহিনীতে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে শুরু থেকে মারমুখী ছিল পুলিশ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। যার ফলে নির্বিচারে গুলি, হত্যা, গণগ্রেপ্তার ও নির্যাতনে অভিযুক্ত পুলিশ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে পড়ে। হামলা-ভাঙচুর করা হয় থানা ও ট্রাফিক স্থাপনায়। পুলিশ সদস্যদের মারধর ও হত্যার ঘটনাও ঘটে। পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীকে পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহন না করে পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া ঠিক হয়নি। পোশাক পরিবর্তনের চেয়ে প্রয়োজন দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সময় উপযোগী বাহিনী তৈরি করা। বঞ্চিত ও যোগ্য কর্মকর্তাদের দ্রুত পদোন্নতি দিয়ে পদায়নের মাধ্যমে পুলিশকে গতিশীল করা খুবই জরুরী। এ সব বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মনোযোগ দেয়া উচিত বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাহিনীর সেবা মান ও মানসিকতায় পরিবর্তন আনা না গেলে শুধু পোশাক পরিবর্তন খুব বেশি কাজে আসবে না। আগেও অনেকবার পোশাক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু পুলিশের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পোশাক পরিবর্তনের পরপরই পুলিশের মনোভাব পরিবর্তন জরুরি। একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত পুলিশ পতিত আওয়ামী লীগের রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২৮ অক্টোবর পল্টনে ডাকা বিএনপির সমাবেশ প-, পরে পার্টি অফিসে কথিত অভিযান ছাড়াও অতীতের নজির ভেঙে নির্বাচনের ঠিক আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ প্রায় সব দলের প্রথম সারির নেতাদের রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যদিও বিরোধী অধিকাংশ দল বয়কট করেছিল জাতীয় নির্বাচন। ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অধিকাংশ প্রথম সারির রাজনৈতিক দল পুলিশি নিষেধাজ্ঞায় ঢাকায় সভা-সমাবেশের অনুমতি পায়নি। পতিত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠা সেই পুলিশ বাহিনী তোপের মুখে পড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে দেয়া এক পোস্টে লিখেছেন, স্বভাব, চরিত্র, খাসলত পরিবর্তন না করে পোশাক পরিবর্তনে কোনো লাভ নাই। সমস্যা পোশাকে না, পুরো সিস্টেমে।
প্রবাসী অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের ফেসবুকে লিখেছেন, নতুন ইউনিফর্মের পেছনে শত কোটি টাকা খরচ না করে র্যাব, পুলিশ, আনসার সদস্যদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও কাঠামোগত উন্নয়নে পর্যায়ক্রমে অর্থ বিনিয়োগ করুন। সংস্থাগুলোর সদস্যদের দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং মানবিক পুলিশিং নিশ্চিত করতে বিশেষ অভ্যন্তরীণ ইউনিট গঠন করে জনসেবামূলক কার্যক্রমে তাদের নিয়োজিত করুন।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, পুলিশের ইউনিফর্ম-লোগো পরিবর্তন হলেই কি মনের পরিবর্তন হবে? ইউনিফর্ম-লোগো পরিবর্তন করে পুলিশের ভেতর পরিষ্কার করতে পারবেন? তাদের মতে, অনেক বার পুলিশের পোশাক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পুলিশের কোন পরিবর্তন হয়নি। নিজেদের কার্যকলাপ পরিবর্তন করতে হবে। জন সংখ্যার অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা অনেক কম। তাই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনবান্ধব পুলিশ তৈরির পাশাপাশি দেশে পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এই পোশাক পরিবর্তনের কারনে বর্তমান সরকারের শত শত কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে শতবার ভাবা উচিত। দ্রুত পদোন্নতি দিয়ে পুলিশের শূণ্যপদ পুরণের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনী গতিশীল করা প্রয়োজন বলে ওই কর্মকর্তারা মন্তব্য করেন।
সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ ইনকিলাবকে বলেন, পোশাক-লোগো পরিবর্তনে পুলিশের বাহ্যিক বিষয়গুলো না দেখে ভেতরেরগুলো দেখা দরকার। আমার প্রশ্ন, এই মুহূর্তে পোশাক পরিবর্তন করা অগ্রাধিকার কি-না। মানুষ একটা জায়গায় এসে প্রথমে প্রায়োরিটি নির্ধারণ করে যে, কোনটা আগে আর কোনটা পরে করা হবে। পোশাক-লোগো পরিবর্তন করে পুলিশের ভেতর পরিষ্কার করতে পারবেন? পারবেন না। আগে অনেকবার লোগো পরিবর্তন হয়েছে, পোশাক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু পুলিশ বাহিনীর কোনো পরিবর্তন হয়নি।
সাবেক এই আইজিপি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে চাইবে পুলিশের লোগোর মধ্যে ধানের শীষ লাগাতে। আওয়ামী লীগ এলে চাইবে ওইগুলো বাদ দিয়ে নৌকা লাগাতে। বর্তমানে অন্তর্বতীকালীন সরকার বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিলেও পরবর্তীতে খুব বেশি কার্যকর হবে তা বলতে পারি না। অন্তর্বতীকালীন সরকার থাকে অল্প সময়ের জন্য। তারা পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো করবে যাতে জনগণ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করতে পারে। এখন জরুরি হলো পুলিশকে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরিয়ে আনা। আনার পর সাধারণ মানুষের আস্থা, বিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে পারে সেই ব্যবস্থা করা। সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ আরও বলেন, পুলিশে দক্ষ কর্মচারী-কর্মকর্তার অভাব নেই। তাদেরকে ভালো জায়গায় প্লেস করা প্রয়োজন। মানুষ যাতে ভালো সেবা পায়। গত কয়েক বছরে পোস্টিং দিয়ে টাকা-পয়সা নেওয়াটা খারাপ করে গেছে। পুলিশের যে ভালো কাজ করবে তাকে পুরস্কার দেবেন আর যে মন্দ কাজ করবে তাকে শাস্তি দেবেন। কনস্টেবল-দারোগাকে শাস্তি দিয়ে লাভ নেই। উপর থেকে ধরতে হবে। দু›একটা ধরে দেখেন কাজ হবে।ই