
অনলাইন ডেস্ক : রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পরেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের সুস্পষ্ট রুপরেখার ঘোষণা না আসায় হতাশ হয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠকের আগে উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে তা বিভ্রান্তিকর বলেছে দলটি।
মঙ্গলবার (২৭ মে) বিকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জাতীয় স্থায়ী কমিটি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এসব কথা বলেন। গতকাল রাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। সেই বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার ফলাফল সম্পর্কে দলের প্রতিক্রিয়া জানাতে জাতীয় স্থায়ী কমিটির পক্ষে এই সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে প্রধান উপদেষ্টার আলোচনার প্রসঙ্গে তাঁর প্রেস সচিবের মাধ্যমে সরকারের যে বক্তব্য পাওয়া গিয়েছে তাতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন রোড ম্যাপের ঘোষণা না থাকায় আমরা হতাশ হয়েছি। বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল কোন সময়েই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চায়নি এবং এখনও চায় না। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোড ম্যাপ দাবি করে এসেছি, এখনো আমরা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। এই সর্বোচ্চ জনআকাক্সক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম এজেন্ডা হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। এর অন্যথা হলে জনগণের দল হিসাবে বিএনপির পক্ষে এই সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার সরকারি বাসভবন যমুনায় গত ২৪ মে প্রথমে বিএনপি, এরপরে জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সাথে এবং পরদিন এলডিপি, নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, খেলাফত মজলিশ, ইসলাম আন্দোলনসহ ২০ টি দলের সাথে বৈঠক করেন।
নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বরই উপযুক্ত সময় মন্তব্য করে ড. মোশাররফ বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি শুধু এই কয়েকদিন নয়, এটা আগের থেকেই বলছি। ডিসেম্বরকে আমরা মনে করছি, নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময়। সেজন্য আমরা ডিসেম্বরের কথা বলেছি। এখনো আমরা সেই কথার মধ্যেই আছি। ডিসেম্বরের পরে আপনারা সকলে জানেন, রোজা চলে আসবে, তারপরে বর্ষা চলে আসবে, তারপরে এসএসসি-এইচএসসির মতো বড় বড় পাবলিক পরীক্ষা আছে। ওই মাসগুলো কিন্তু নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় না। অতীতে যত নির্বাচন হয়েছে কেবল একটি নির্বাচন বাধ্যবাধ্যকতা থাকাতে জুন মাসে হয়েছিল। এছাড়া নির্বাচনই ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারি এই সময়টাতেই হয়েছে।
নির্বাচন বিলম্বে কিছু উছিলা বের করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা নির্বাচন চাই। যেটা সরকার করতে চাচ্ছে সেটাই আমরা চাচ্ছি, তরান্বিত করার জন্য। যেমন আমরা তো সংস্কারের পক্ষে। এই সরকার আসার আগেই আমরা ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব জনগণের সামনে তুলে ধরেছি। আমরা ওয়াদা করেছি যে, জনগণ যদি আমাদের ক্ষমতায় বসায় তাহলে আমরা ৩১ দফার কর্মসূচির ভিত্তিতে সংস্কার করব। সংস্কার তো আমরাও চাচ্ছি, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। ইচ্ছা করলে ওমুক দিন ওমুক সময়ের মধ্যে সংস্কার শেষ করা যাবে এটা কেউ বলতে পারে না। ঠিক একইভাবে নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য কিছু উছিলা বের করা হচ্ছে। যেমন একটা উছিলা হলো বিচার শেষ করতে হবে। আমরাও তো বিচার চাই। এই আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে তারা আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য কি করেনি? তারা বিচারবর্হিভ‚ত হত্যাকাÐ, গুম-খুন, আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান থেকে থেকে শুরু করে কেউ বাকি নেই যারা আমরা মিথ্যা মামলার আসামী ছিলাম না, জেল খাটিনি বিভিন্ন সময়। এর পরে কেনো প্রশ্ন আসে যে, আমরা তাদের বিচার চাইব না?
প্রশ্ন রেখে বিএনপির এই নেতা বলেন, বিএনপি সবচাইতে বেশি তাদের বিচার চায়। তবে আমরা এটা বিশ্বাস করি যে, বিচার হতে হবে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মধ্যে। আমি স্বাধীন বিচারও চাইব আবার ওমুক দিনের মধ্যে এই বিচার করতে হবে, এটা তো সাংঘর্ষিক। সেজন্য আমরা বলছি, এই সংস্কার, নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও বিচারের প্রক্রিয়া, এটা পৃথক, আলাদা এবং সেজন্য এখানে কোনো সাংঘর্ষিক কিছু নেই। তাই এই তিনটা কাজই একসাথে চলতে পারে এবং সেটা চলা উচিত।
ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার নাগালের মধ্যে রাখতে, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা আনায়নের লক্ষ্যে সরকার ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন, এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের বিবৃতি বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে খন্দকার মোশাররফ বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি, গত ২৪ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের সভা শেষে উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে যে বক্তব্য জাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে তা অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর। উপদেষ্টা পরিষদের দায়িত্ব পালনে আমরা প্রথম থেকে অদ্যাবদি সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদান করে আসছি। সরকার পরিচালনায় নিরপেক্ষতার ঘাটতির কারনে এবং দূর্বলতার কারনে জনমনে সংশয় ও সন্দেহের উদয় হওয়া স্বাভাবিক। বিভিন্ন মহলের অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত দাবি-দাওয়া এবং এখতিয়ার বর্হিভ‚ত বক্তব্য সরকারের স্বাভাবিক কাজের পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার যে অভিযোগ সরকারের পক্ষ থেকে উত্থাপন করা হয়েছে, সেটা মূলত সরকারের নিজস্ব অর্জন।
তিনি বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে সরকারের উপর দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তোলা হচ্ছে। আমরা বলতে চাই, যথাশিগগিরই একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমেই পরাজিত শক্তির ইন্ধন এবং বিদেশী ষড়যন্ত্র বন্ধ করা সম্ভব। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য অবিলম্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রোড ম্যাপ প্রদান করা জরুরি, এর কোন বিকল্প নেই।
ড. মোশাররফ বলেন, দেশকে স্থিতিশীল রাখতে, নির্বাচন, বিচার ও সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে এবং চিরতরে এদেশে স্বৈরাচারের আগমন প্রতিহত করতে ফ্যাসীবাদ বিরোধী বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। জুলাই ছাত্র- গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা এবং জনপ্রত্যাশাকে ধারন করে অতি শিগগিরই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করা অতি জরুরি। এই লক্ষ্যে আমরা সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছি। সরকারের স্বকীয়তা, সংস্কার উদ্যোগ, বিচার প্রক্রিয়া, সুষ্ঠু নির্বাচন ও স্বাভাবিক কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কোন কর্মকাÐকে আমরা সকল সময়ে নিরুসাহিত করি এবং প্রতিরোধ করার অঙ্গিকারাবদ্ধ। অথচ উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে কোন কোন মহল তাদের উপরে অর্পিত দায়িত্ব পালনকে অসম্ভব করে তুলছে মর্মে একটি বিমূর্ত অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
ইশরাকের শপথ প্রসঙ্গে খন্দকার মোশাররফ বলেন, জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সকল শ্রেণী পেশার শক্তির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না হয়, যাতে ঐক্যকে আরও শক্তিশালী করা যায় সেই জন্য সরকারের নিরপেক্ষ ভ‚মিকা এবং চরিত্র বজায় রাখার স্বার্থে আমরা বিতর্কিত উপদেষ্টাদের অপসারণ চেয়েছি। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই এদেশের জনগণ রক্ত দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ফ্যাসীবাদের পতন ঘটিয়েছে। অথচ সরকারের সা¤প্রতিক কর্মকান্ডে জনমনে এ বিষয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি ইশরাকের শপথ বিলসিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে জনাব ইশরাক হোসেনের পক্ষে আদালতের রায় অনুযায়ী গেজেট নোটিফিকেশন হয়েছে। অথচ সরকার আজ পর্যন্ত তার শপথ গ্রহণের জন্য কোন ব্যবস্থা নেয়নি। আমরা আশা করি, কাল বিলম্ব না করে সরকার তার শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা নিবে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।ই