
খবর ডেস্ক :
জরিমানা ৭৫ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা করা হচ্ছে
গ্রাম আদালত সংশোধন আইন সোমবার মন্ত্রিসভায় উঠছে। সংশোধনী আইনে এবারে ৮টি ধারা সংশোধন ও ২টি নতুন বিষয়ে সংযোজন করা হচ্ছে। বিচার নিষ্পত্তির সময়সীমা ৩০ দিনের পরিবর্তে ১৫দিন করা হচ্ছে এবং গ্রাম আদালতের আর্থিক এখতিয়ার ৭৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ৩ লাখ টাকা করা হচ্ছে। গ্রাম আদালতে গ্রামের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারী, দরিদ্র ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, ছোটখাটো বিরোধ দ্রæত ও স্বল্প ব্যয়ে মীমাংসার সুযোগ পায়। এতে ন্যায়বিচার সহজলভ্য ও দ্রæততর হয়। বাংলাদেশ গ্রাম আদালত আইন সফল বাস্তবায়নকালের মাঠপর্যায়ে কমিপয় সীমাবদ্ধতার পরিলক্ষিত হয়। জেলা পর্যায়ে কর্মরত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জাতীয় পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শক্রমে গ্রাম আদালত আইনের কতিপয় ধারা সংশোধনের প্রস্তাবের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। গ্রাম আদালতের আইনি কাঠামো পুন:পর্যালোচনাপূর্বক কতিপয় সংশোধনী আনায়নের জন্য ‘গ্রাম আদালত (সংশোধন) আইন-২০২৪ সংশোধনের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। গ্রাম আদালতে আইনে এবারে ৮টি ধারা সংশোধন ও ২টি নতুন ধারা সংযোজন এবং তফসিলে সংশোধনীর প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের এখতিয়ারাধীন এলাকায় কতিপয় বিরোধ ও বিবাদের সহজ ও দ্রæত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গ্রাম আদালত গঠনকল্পে প্রণীত আইন। সংশোধনী প্রস্তাব গুলো হচ্ছে, নাবালক শব্দের পরিবর্তে শিশু শব্দটি প্রতিস্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পরিবর্তন, সংজ্ঞায় স্থানীয় কৃর্তপক্ষ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, গ্রাম আদালত গঠণ এবং কার্যক্রম, প্রাক বিচারকালীন নিম্পত্তির সময়সীমা ৩০ দিনের পরিবর্তে ১৫দিন করার প্রস্তার দেয়া হয়েছে। গ্রাম আদালত কর্তৃক তফসিলের প্রথম অংশের বর্ণিত অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে ক্ষতিপুরণ প্রদানের ক্ষমতা ৭৫ হাজার টাকার পরিবর্তে বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। মামলা পক্ষভুক্তি সংক্রান্ত সংশোধনী, গ্রাম আদালতের আর্থিক এখতিয়ার ৭৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ৩ লাখ টাকার করে তফসিলে সংশোধনের প্রস্তাব আনা হয়েছে। গ্রাম আদালত যে কোনো ব্যক্তিকে আদালতে হাজির থেকে এবং সাক্ষী দেয়ার জন্য অথবা কোনো দলিল দাখিল করার জন্য সমন দিতে পারবে এমন সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করে আইনের খসড়া প্রস্তাব, গ্রাম আদালত (সংশোধন) আইন,২০২৪ এর খসড়া গত ২০২২ সালের ২৫ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দিয়েছে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়। সেগুলো যাচাই-বাছাই করে আগামী সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বলে জানা গেছে। মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদনের পরে গত বছর ১২ সেপেম্বর লেজিসলেটিভ সংসদ বিষয়ক বিভাগ থেকে আইনের খসড়াটি ভেটিং সম্পন্ন করে আবারো স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়। এর পরে গত বছর ২৩ অক্টোবর আইনের খসড়াটি আবারো মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হয়। মন্ত্রিসভা থেকে চুড়ান্ত ভাবে অনুমোদন দেয়া হয়। পরবর্তীতে গত বছর ২ নভেবম্বর জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন হওয়ার কারণে গ্রাম আদালত সংশোধন আইন,২০২৩” এর খসড়া বিল আকারে একাদশ জাতীয় সংসদের অদিবেশনে উঙ্খাপন করা হয়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকার এবং নতুন মন্ত্রিসভা গঠন হওয়ায় গ্রাগ আদালত সংশোধন আইন, ২০২৪ এর খসড়া নতুন মন্ত্রিসভায়র অনুমোদনের প্রয়োজন।
জানা গেছে, গ্রাম আদালত কার্যকর করেছিল প্রয়াত সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার। গ্রামীণ বিচার-আচার স্থানীয় পর্যায়ে নিষ্পত্তি করার জন্য ১৯৭৬ সালে গ্রাম আদালত চালু হয়। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ মেয়াদে আদালতটি জনপ্রিয় হয়। পরে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার ২০০৬ সালে গ্রাম আদালত আইন করলেও তেমন সারাপড়েনি। আইনটি কার্যকর হয় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। গ্রাম আদালত সাফল্যের মুখ দেখার কারণেই সরকার আইনটি দ্বিতীয় দফায় সংশোধন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
দেশে বিচারাধীন মামলা প্রায় ৩৭ লাখ। তবে বেসরকারি হিসাবে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। মূলধারার বিচারব্যবস্থায় ঝুলে থাকা এসব মামলা বিচারপ্রার্থীদের হয়রানির অন্যতম কারণ। মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ভার ও ব্যবস্থাগত জটিলতার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ বিচার পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। উচ্চ আদালত থেকে মামলার চাপ কমাতে, একই সঙ্গে জনগণের কাছে স্থানীয় বিচারব্যবস্থার সুযোগ পৌঁছে দিতে সরকার গ্রাম আদালতকে আরো কার্যকর করতে চায়। গ্রাম আদালত উচ্চ আদালতে মামলার জট কমাতে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করছে। এ পর্যন্ত ৬ হাজার ৪৪টি মামলা উচ্চ আদালত থেকে গ্রাম আদালতে স্থানান্তর করা হয়েছে। সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা মূল্যমানের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারেন গ্রাম আদালত। স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে দেশের গ্রাম আদালতগুলোতে মামলা হতো ছয় থেকে সাত হাজার।
গত কয়েক বছরে ২৭ জেলার ১ হাজার ৮০টি ইউনিয়নের গ্রাম আদালতে মোট ২ লাখ ২৭ হাজার ২৩৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৯০ হাজার ৮৫৭টি নিষ্পত্তি হয়েছে, যা ৮৪ শতাংশ। এই সময়ে ১৮৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে ক্ষতিগ্রস্তপক্ষকে দেয়া হয়েছে। গ্রাম আদালতে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষমতা পাচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা।দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের এখতিয়ারাধীন এলাকায় কতিপয় বিরোধ ও বিবাদের সহজ ও দ্রæত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গ্রাম আদালত গঠনকল্পে প্রণীত আইন। যেহেতু দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের এখতিয়ারাধীন এলাকায় কতিপয় বিরোধ ও বিবাদের সহজ ও দ্রæত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গ্রাম আদালত গঠন করা হয়। এদিকে গ্রাম আদালত আইন দ্বিতীয় দফায় সংশোধন করার প্রক্রিয়া শুরু হলে তারা পুলিশকে বাধা দিচ্ছে বলে স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আইনটি মন্ত্রিসভা থেকে চুড়ান্ত ভাবে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন হওয়ার কারণে গ্রাম আদালত সংশোধন আইন,২০২৩ এর খসড়া বিল আকারে একাদশ জাতীয় সংসদের অদিবেশনে উঙ্খাপন করা হয়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকার এবং নতুন মন্ত্রিসভা গঠন হওয়ায় গ্রাগ আদালত সংশোধন আইন, ২০২৪ এর খসড়া নতুন করে অনুমোদনের প্রয়োজন। তিনি বলেন, দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে গ্রাম আদালতকে কার্যকর ও শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। গ্রাম আদালতকে শক্তিশালী করতে পারলে জেলা পর্যায়ের আদালতসমূহে মামলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। আমরা গ্রাম আদালতের কিছু ধারা সংশোধন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছি।
সারাদেশে মামলার জটাজালে বিপর্যস্ত বিচারাঙ্গন। বিদ্যমান কোর্ট-কাচারিগুলোর ত্রাহি দশা। বিশৃঙ্খলা, দুর্ভোগ, অনিয়ম-দুর্নীতির ভিড়ে মামলার ফেরে পড়া বিচারপ্রার্থীর রুদ্ধশ্বাস ছোটাছুটি। রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার এ এক জটিল কঠিন সমীকরণ। এসবের ধার না ধেরে প্রতিষ্ঠিত সরল এক বিচারব্যবস্থার নামই হচ্ছে ‘গ্রাম আদালত’। যে আদালতে নেই কালো গাউন পরা উকিল-মোক্তার-পেশকার। তবে রয়েছে লাল সালু বেষ্টিত এজলাস, কাঠগড়া। তবে নেই ১৪ শিকের গারদ। ইউনিয়ন পরিষদে বসছে ‘আদালত’। ফরিয়াদী-প্রতিবাদী উভয়েই হাজির। মজলিসে উপস্থিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। বাদী-বিবাদী সপক্ষে প্রমাণ ও সাক্ষী-সাবুদ হাজির করেন। তারা উভয়ের কথা গভীর মনোযোগ সহকারে শোনেন। অতঃপর হাজেরানে মজলিসের সামনে থমথমে ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে ঘোষিত হয় রায়। সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষিত এ রায় উভয়পক্ষ মেনে নিতে বাধ্য। কারণ এই ‘গ্রাম আদালত’-এর রয়েছে আইনগত শক্ত ভিত্তি। গ্রামে বসবাসকারী প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের আইনগত প্রতিকার লাভের জায়গা হিসেবে ক্রমেই আস্থা লাভ করছে গ্রাম আদালত।
দীর্ঘদিন থেকেই বিরোধ-বিবাদ মীমাংসার মাধ্যম হিসেবে সালিসি ব্যবস্থা প্রচলিত। সালিসি ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য ১৯৭৬ সালে গ্রাম আদালত অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইউনিয়ন পর্যায়ে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৬ সালের গ্রাম আদালত আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষ মনোনীত দু’জন করে মোট চারজন সদস্য নিয়ে গ্রাম আদালত গঠন করা হয়। তবে প্রত্যেক পক্ষ মনোনীত দু’জন সদস্যের মধ্যে একজন সদস্যকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গ্রাম আদালতের চেয়ারম্যান হন। চেয়ারম্যান কোনো কারণে তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে বা তার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে আপত্তি উঠলে, পরিষদের অন্য কোনো সদস্য আদালতের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো পক্ষ সদস্য মনোনয়ন না দিলে ওই মনোনয়ন ছাড়াই আদালত বৈধভাবে গঠিত হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। যদি কোনো পক্ষ ইউনিয়ন পরিষদের কোনো সদস্যকে পক্ষপাতিত্বের কারণে মনোনীত করতে না পারে, তাহলে চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমে অন্য কোনো ব্যক্তিকে মনোনীত করা যায়। গ্রাম আদালত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলে তা অন্য কোনো আদালতে পুনরায় বিচার করা যায় না। তবে এই আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ থাকবে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৩ সালে গ্রাম আদালত আইন সংশোধন করে ইউনিয়ন পরিষদকে ছোটখাটো মামলা নিষ্পত্তির ক্ষমতা দেয়। তারই আলোকে ‘গ্রাম আদালত বিধিমালা, ২০১৬ জারি করে গ্রাম আদালত ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করা হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সরকারি দলের। তাদের হাতে বিচারের ভার দেয়া নিরাপদ হবে কি না তা সঠিক বলতে পারব না। তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদুষ্ট বিচার করার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ইউনিয়ন পর্যায়ের এই আদালত জজ আদালতে মামলার চাপ কমিয়ে গোটা বিচারব্যবস্থায় গতিশীলতা এনেছে। তবে জনপ্রতিনিধিদের আচরণগত ত্রুটির কারণে এই আদালত অনেক সময় ভাবমর্যাদা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু আইনগত দিক থেকে গ্রাম আদালত একটি পূর্ণাঙ্গ আদালত।