
অনলাইন ডেস্ক : ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ডেঙ্গু আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। ডেঙ্গু সংক্রমণের ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়তে পারে বাংলাদেশ। এমন সতর্কবার্তা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ২৮৮ জন ভর্তি হয়েছেন। থেমে থেমে বৃষ্টি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, মশক নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা ও নিয়মিত ওষুধ না দেয়াকে দায়ী করছেন তারা। ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকায় আক্রান্তের হার ক্রমেই বাড়ছে। সিটি কর্পোরেশনগুলোর প্রস্তুতি সীমিত। স্থানীয় পর্যায়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, গৃহস্থালি পানির পাত্র ব্যবস্থাপনা এবং জনগণকে সচেতন করার কাজ দ্রুত শুরু না করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এদিকে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম আন্দোলনের জন্য বন্ধ থাকায় এই এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বাসিন্দারা।
২০২৪ সালে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সারা বছর আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং প্রাণ হারান ৫৭৫ জন। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় ঢাকায়, যেখানে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর ওপর চাপ ছিল ভয়াবহ। বিগত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও এ বছরের শুরুতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ২৮৮ জন ভর্তি হয়েছেন। এ সময় নতুন করে কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্য সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ২৮৮ জন। তাদের মধ্যে বরিশাল বিভাগেই ২৬১ জন, ঢাকা দক্ষিণে ১২, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১, ময়মনসিংহে দুইজন এবং রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগে একজন করে আক্রান্ত আছে।
অধিদফতরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত এক হাজার ১৬১ জন ও মৃত্যু ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার ৫৩৫ জন ও মৃত্যু ১৩ জন, মার্চ মাসে আক্রান্ত এক হাজার ৮৭১ জন ও মৃত্যু ১৩ জন, এপ্রিল মাসে আক্রান্ত দুই হাজার ৫৭২ জন ও মৃত্যু ২০ জন, মে মাসে আক্রান্ত চার হাজার ৩৪৫ জন ও মৃত্যু ২৩ জন। চলতি মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছেই। এছাড়া ২০২৪ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন ও মৃত্যু ৫৭৫ জন। এর আগের বছর (২০২৩) আক্রান্ত তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ও মৃত্যু এক হাজার ৭০৫ জন। ২০২২ সালে আক্রান্ত ৬২ হাজার ৩৮২ জন ও মৃত্যু ২৮১ জন। ২০২১ সালে আক্রান্ত ২৮ হাজার ৪২৯ জন ও মৃত্যু ১০৫ জন।
ডেঙ্গু সংক্রমণের ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ এমন সতর্কবার্তা দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের বিশেষজ্ঞরা। তাদের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার প্রতিটি ১৫টি বাড়ির মধ্যে গড়ে সাত থেকে আটটিতেই এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। যা ব্রুটো লার্ভা ইনডেক্স অনুযায়ী আশঙ্কাজনকভাবে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ প্রফেসর ড. কবিরুল বাশার জানান, ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে তৈরি তাদের কম্পিউটার ভিত্তিক পূর্বাভাস মডেলে দেখা যাচ্ছে, এ বছর ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ ভয়াবহ আকার নিতে পারে। তিনি বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব, রোগীর সংখ্যা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা একটি ফরকাস্টিং মডেল তৈরি করেছি। এতে দেখা যাচ্ছে, যদি এখনই এডিসের প্রজননস্থল ধ্বংসে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তবে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক বেড়ে যাবে।
তবে জরিপের এই তথ্য মানতে নারাজ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। তারা দাবি করছে, এডিস মশা নির্মূলে নিয়মিত অভিযান চলছে এবং মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন অন্তত এক হাজার কর্মী। নতুন ওষুধের ট্রায়াল চালানো হচ্ছে এবং প্রতিদিন চারবার তাদের হাজিরা নেয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন দুই সিটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। ঢাকা উত্তর সিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, গুলশান এলাকায় বিটিআই ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে ছিটানো হয়েছে এবং তার কার্যকারিতা প্রমাণে প্রেজেন্টেশনও উপস্থাপন করা হয়েছে। এ দিকে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চাপ বাড়ছে। মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিনই ভর্তি হচ্ছে নতুন রোগী।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের ৯ জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৪৭৭ জন। এই সময়ের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্ষাকাল পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই যে হারে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, তাতে করে এখনই সতর্ক না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
ঢাকার যাত্রাবাড়ির বাসিন্দা সবুজ মিয়া বলেন, আমাদের এলাকায় প্রতিবছরই ডেঙ্গুর সংক্রমনের হার বেশি দেখা যায়। সামান্য বৃষ্টিও এখন ভয় জাগাচ্ছে নাগরিক মনে। কারণ, প্রতিটি পানির গর্ত হতে পারে মরণব্যাধি ডেঙ্গুর আঁতুড়ঘর। এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তি, পরিবার, স্থানীয় সরকার এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্মিলিত সচেতনতা ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।ই