খবর ডেস্ক :
উচ্ছ্বাস নেই বেশ কিছু আওয়ামী পরিবারে
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে এবার নানা চমক ছিল। বাদ পড়েছেন বর্তমান সংসদের ৩ প্রতিমন্ত্রীসহ ৭২ জন এমপি। স্থান পেয়েছেন নতুন মুখ। রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি নৌকার মাঝি হয়েছেন সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গনের তারকাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার পরিচিত মুখ। এসব প্রার্র্থী ইতোমধ্যে ভোটের মাঠেও নেমেছেন। জমে উঠেছে ভোটের আমেজ। তবে আওয়ামী লীগের এই ভোট উৎসব-উদ্দীপনার মধ্যে দলের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব রাখা বেশ কিছু পরিবারে সেই উচ্ছ্বাস নেই। এসব পরিবারের কেউই এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। এর মধ্যে রয়েছে-টাঙ্গাইলের খান পরিবার এবং সুনামগঞ্জের সেনগুপ্ত, মাগুরার মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান, নওগাঁর ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক, নেত্রকোনার কর্নেল আবু তাহেরের পরিবার। এছাড়া এর আগে উপনির্বাচনে বাদ পড়েছিলেন এমন কয়েকটি প্রভাবশালী পরিবারেও কাউকে এবার জাতীয় নির্বাচনেও দেওয়া হয়নি নৌকা। তবে দু-একটি আসনে এসব পরিবারের কেউ কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মাঠে নেমেছেন। আবার কোথাও দলের প্রার্থীর পক্ষে মাঠেও নেমেছেন কোনো কোনো পরিবারের সদস্যরা।
আসন্ন নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চেয়ে ৩৩৬২টি ফরম কেনেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। প্রধানমন্ত্রী দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে টানা চার দফা আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় তাদের মধ্য থেকে প্রার্থী তালিকা চ‚ড়ান্ত করা হয়। রোববার তিনশ আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে দলের প্রার্র্থী ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের দাবি-বিভিন্ন সংস্থার জরিপ এবং দলের সাংগঠনিক রিপোর্ট বিবেচনায় নিয়ে কয়েকটি ক্রাইটেরিয়া দেখে প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। অধিক জনপ্রিয়তা, দলে গ্রহণযোগ্যতা, দুর্দিনে মানুষের পাশে থাকা এবং পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির প্রার্থীদের বেছে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
সত্তরের নির্বাচন থেকে হাওড়-ভাটির দুর্গম এলাকা দিরাই-শাল্লার আসনটি একচ্ছত্রভাবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দখলে ছিল। মোট আটবার তিনি সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে সংসদ-সদস্য হন। ‘বামপন্থার ঘাঁটি’ হিসাবে একদা পরিচিত এই এলাকায় তিনি সবার কাছেই ‘সেনবাবু’ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর সেখানে সংসদ সদস্য হন তার স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তা। একাদশ জাতীয় সংসদের তিনি আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচিত হন। ফলে বলা যায়, প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে ‘সেন পরিবার’ জাতীয় সংসদের এই এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেছে। আওয়ামী লীগ থেকে এবার এই আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মাহমুদকে।
মোহাম্মদ আছাদুজ্জামান মাগুরা জেলা থেকে চারবার সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য হিসাবে দায়িত্বপালন করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি মাগুরা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন যশোর-১১ আসন থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৮৬ সালে তিনি তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-২ সংসদীয় আসন থেকে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি জাতীয় সংসদের মাগুরা-২ সংসদীয় আসনের সংসদ-সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মোহাম্মদ আছাদুজ্জামানের ছেলে সাইফুজ্জামান শিখর মাগুরা-১ আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য। এক মেয়ে কামরুল লায়লা জলি জাতীয় সংসদের সাবেক সংসদ-সদস্য।
মাগুরা-১ আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি সাইফুজ্জামান শিখর। সাইফুজ্জামান শিখর ছাত্রাবস্থা থেকেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দলের মনোনয়নে সংসদ-সদস্য হওয়ার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপিএস হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সর্বশেষ ঘোষিত আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকা থেকে বাদ পড়েন এবং তার আসনে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে নৌকার প্রার্থী করা হয়। দলের মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর নৌকার প্রার্থীকে সার্বিক সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছেন শিখর।
টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনে মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েছেন বর্তমান সংসদ-সদস্য আতাউর রহমান খান। তিনি এ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য শামসুর রহমান খানের ভাই এবং সাবেক সংসদ-সদস্য আমানুর রহমান খানের বাবা। শামসুর রহমান খান এ আসন থেকে সাতবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেন। তিনি তিনবার সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমানুর রহমান খান ২০১২ সালের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রথম সংসদ-সদস্য হন। পরে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আতাউর রহমান খান মনোনয়ন পান।
টাঙ্গাইলের খান পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে এই পরিবারের দাপট ও প্রভাবও ব্যাপক। তবে আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হত্যা মামলায় এই পরিবারের সদস্যরা জড়িত থাকার বিষয়ে সামনে আসার পর থেকে রাজনীতিতে দাপট কমেছে তাদের। এবার এই পরিবারের কাউকে মনোনয়ন না দেওয়ার মাধ্যমে সেই দাপট আরও কমল বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। এবার দীর্ঘদিন পর ‘খান পরিবারের’ বাইরে কেউ মনোনয়ন পেলেন।
নেত্রকোনা-৫ আসনে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহেরের ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের জায়গায় তাদের পরিবারের কাউকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। এই আসনের টানা তিনবারের সংসদ-সদস্য ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল। বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নে নির্বাচন করে বিএনপির মোহাম্মদ আলীর কাছে পরাজিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আবার ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের ওপর আস্থা রেখে মনোনয়ন দেয়। সেবার তিনি বিএনপির মোহাম্মদ আলীকে পরাজিত করে জয়ী হন।
২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে আইনপ্রণেতা হন ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল। এবার তিনি অসুস্থ থাকায় মনোনয়ন চেয়েছিলেন তার ছোট ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আনোয়ার হোসেন। কিন্তু দলের মনোনয়ন পাননি। এই আসনে এবার দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনকে। এর মধ্য দিয়ে টানা প্রায় দেড় দশক পর কর্নেল তাহের পরিবারের বাইরে গেল নৌকা।
নওগাঁ-৪ (মান্দা) আসনের বর্তমান সংসদ-সদস্য ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক ২০১৪-২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্র্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নওগাঁ-৪ আসন থেকে পাঁচবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে এবং একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়ে এমপি হয়ে বর্তমানে সংসদে আছেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নওগাঁর গুরুত্বপূর্ণ এই পরিবার এবার নৌকার বাইরে। তবে নৌকা না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোটের মাঠে রয়েছেন সংসদ-সদস্য ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক।
আব্দুল কুদ্দুস নাটোরে আওয়ামী রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত নাম। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ বিভিন্ন পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। আব্দুল কুদ্দুস দুই মেয়াদে আমৃত্যু নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে দলের সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত ৩০ আগস্ট মারা যান আব্দুল কুদ্দুস। তার মৃত্যুর পর সম্প্রতি অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে তার পরিবারের কাউকে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তার মেয়ে কেন্দ্রীয় যুব মহিলা লীগ নেত্রী কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি মনোনয়ন চাইলেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারি। এবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারিকেই বেছে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
ঢাকা-৫ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য ও বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান মোল্লা। ঢাকার অন্যতম প্রবেশমুখ ডেমরা-যাত্রবাড়ী এলাকার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন এই মোল্লা পরিবারের প্রভাব ছিল। হাবিবুর রহমান মোল্লা ১৯৯১ সালে প্রথম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। পরে ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ঢাকা-৪ আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে হাবিবুর রহমান মোল্লা ঢাকা-৫ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান এবং জয়ী হন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি পুনরায় সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। তার মৃত্যুর পর এই আসনটিও মোল্লা পরিবারের বাইরে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান মোল্লা সজল মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তবে তার পরিবর্তে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে হারুনর রশীদ মুন্নাকে।