
অনলাইন ডেস্ক : হাসিনার শাসনামলে গুম-খুনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তাদের (হেফাজতে থাকা) আজকের মধ্যে (বুধবার) হাজির করা না হলে তাদের আত্মসমর্পণ করতে সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। এমন কথা জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম।
গতকাল মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সেনা হেফাজতে থাকা কর্মকর্তাদের হাজির করা হবে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। প্রসিকিউটর তামিম বলেন, যদি তারা (হেফাজতে থাকা কর্মকর্তারা) বুধবার হাজির না হন অথবা তাদের হাজির করা না হয় তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হওয়ার জন্য দুটি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হবে। একটি তারিখ নির্ধারণ করা হবে, ওই দিনই যেন তারা ট্রাইব্যুনালে হাজির হন। মামলা সম্পর্কে জানার জন্য বা মামলায় অ্যাপিয়ার হওয়ার জন্য। পত্রিকার বিজ্ঞপ্তির দিনেও যদি তারা হাজির না হন তবে তাদের ‘পলাতক’ ঘোষণা করে তাদের পক্ষে একজন স্টেট ডিফেন্স কাউন্সিল নিযুক্ত করা হবে। সেই স্টেট ডিফেন্স কাউন্সিল তাদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করবেন। এটি হচ্ছে ট্রাইব্যুনালের বিধান।
তিনি বলেন, প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন সাবেক এবং সার্ভিং সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইনফোর্স ডিস-অ্যাপিয়ারেন্সের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। ২২ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে ওই মামলা দুটির নির্ধারিত তারিখ আছে। ট্রাইব্যুনালের অর্ডারশিট থেকে দেখা যায় যে এই তারিখে বলা হয়েছে যে, ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশকে অর্ডার দেয়া হয়েছিল যে, তিনি এই ওয়ারেন্ট অব অ্যারেস্ট অ্যাক্সিকিউট করবেন।
গাজী এম এইচ তামিম আরো বলেন, যেসব আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে তাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও অ্যারেস্টের একটা কপি পাঠানো হয়েছিল। এখন এই আইন অনুযায়ী দুটি কাজ তারা করতে পারেন। একটি হলো যে, তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এই ওয়ারেন্ট অব অ্যারেস্ট সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে ট্রাইব্যুনালে এসে হাজির হতে পারেন। অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেফতার করে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসতে পারে। এই দুটির যেকোনো একটি হতে পারে। ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী যদি তারা হাজির হন অথবা গ্রেফতার করে তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ট্রাইব্যুনাল চাইলে তাদের জামিন প্রদান করতে পারেন। যদি তারা জামিন চায় এবং জামিনের গ্রাউন্ড থাকে অথবা তাদের জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দিতে পারেন। যদি জেলহাজতে তাদের পাঠনোর আদেশ দেন, তাহলে কারা কর্তৃপক্ষ যেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে সিদ্ধান্ত নেবেন যে তারা কোন কারাগারে থাকবেন।
এই মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের ওপর কোনো চাপ রয়েছে কি না- জানতে চাইলে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বলেন, ইতোমধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। এছাড়াও সাবেক বেশ কয়েকজন মন্ত্রী যারা রাষ্ট্রের উচ্চতর অবস্থানে ছিলেন। এমনকি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মামলা এখানে চলছে। সাবেক অনেক রিটায়ার্ড এবং সার্ভিং আর্মি অফিসারও এখানের জুলাই গণহত্যার বা জুলাই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় নিয়মিত হাজির করা হচ্ছে। এখানে আসামি কে আমরা সেটা দেখছি না। আমরা দেখছি যে আইন কী বলছে। আইন একজন অভিযুক্তকে যতটুকু সুবিধা দিতে বলেছে প্রসিকিউশন পূর্ণ সুবিধা দেয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
প্রসঙ্গত, হাসিনার শাসনামলে গুম-খুন-নির্যাতনের পৃথক তিন তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে বর্তমান এবং অবসরপ্রাপ্ত ২৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৮ অক্টোবর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এর পরপরই ১১ অক্টোবর ২৫ কর্মকর্তার মধ্যে কর্মরত ১৫ কর্মকর্তাকে সেনা হেফাজতে নেয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ওই দিন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়া ২৫ কর্মকর্তার মধ্যে ১৫ জন এখনো সেনাবাহিনীতে কর্মরত রয়েছেন। একজন অবসর-পূর্ব ছুটিতে (পিআরএল) আছেন। ১৬ জনের মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ ছাড়া বাকি সবাই এখন সেনা হেফাজতে আছেন। কবীর আহাম্মদ এখন আত্মগোপনে। পরে ১৩ অক্টোবর সরকার ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থিত ৫৪ নম্বর ভবনকে ‘অস্থায়ী কারাগার’ ঘোষণা করে।
তবে হেফাজতে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের ‘গ্রেফতার’ কিংবা ‘আটক’ করা হয়েছে কি না- এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।
মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, পরোয়ানা এখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়নি। তবে গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিষয়টি সেনা সদরের নজরে এলে ৮ অক্টোবর সন্ধ্যায়ই একটি সংযুক্তির আদেশ জারি করা হয়। এ আদেশের মাধ্যমে চাকরিরত ১৫ জন এবং পিআরএল ভোগরত একজনসহ মোট ১৬ কর্মকর্তাকে ৯ অক্টোবরের মধ্যে সেনা হেফাজতে আসতে নির্দেশনা দেয়া হয়। পিআরএল ভোগরত কর্মকর্তাসহ ১৫ জন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেনা হেফাজতে আসেন।
সেনাবাহিনীর এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সেনাবাহিনী দ্ব্যর্থহীনভাবে বিচারের পক্ষে অবস্থান করে। সেনাবাহিনী ন্যায়বিচারের পক্ষে। নো কম্প্রোমাইজ উইথ ইনসাফ। আমরা বিশ্বাস করি, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। গুমের শিকার পরিবারগুলোর প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।
এদিকে হেফাজতে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের আজ (বুধবার) গ্রেফতার পরোয়ানা অনুযায়ী হাজির করা হবে কি না- এ নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন-আলোচনা। তাদের পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত বিদ্যমান ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হবে নাকি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্প্রসারিত করে সেখানে হাজির করা হবেÑ এমন সম্ভাবনার কথা বলছেন কেউ কেউ। ফলে এ নিয়ে বিচারপ্রার্থী, আগ্রহী মহলের মধ্যে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, সামরিক বাহিনীর এই পদস্থ কর্মকর্তাদের প্রচলিত আইনের আওতায় ট্রাইব্যুনালে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে? নাকি অন্য কোনো পন্থা অবলম্বন করা হবে?ই