অস্থিরতায় বাড়ছে খুনোখুনি

চট্টগ্রামে স্বজনের হাতে আপনজন হত্যায় উদ্বেগ-শঙ্কা : নেপথ্যে পারিবারিক-সামাজিক কলহ

নিজস্ব প্রতিনিধি : চট্টগ্রামে হঠাৎ বেড়ে গেছে খুনের ঘটনা। আধিপত্য বিস্তারে রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের বিরোধেও লাশ পড়ছে। আবার স্বজনের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে আপনজনের হাত। ছেলের হাতে মা-ভাই, বাবা হত্যা কিংবা স্বামী ও পরকীয়া প্রেমিকের হাতেও খুনের ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা সেই সাথে পারিবারিক কলহ-বিরোধে লাশের পর লাশ পড়ছে। তাতে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। বিশেষ করে স্বজনের হাতে আপনজন খুনের ঘটনায় উদ্বেগ-শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারহীনতার কারণে খুনের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধ বেড়েই চলছে। আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তুচ্ছ ঘটনা মানুষের জীবন যাচ্ছে। এ জন্য নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দায়ী করছেন তারা। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধসহ নানা রকম অস্থিরতার কারণে খুনের ঘটনা ঘটছে। তবে পুলিশ প্রায় সবকটি ঘটনায় তড়িৎ ব্যবস্থা নিচ্ছে। খুনের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার সেই সাথে খুনের রহস্য উদঘাটনেও কাজ করছে।

ঈদের আগে পরে চট্টগ্রাম মহানগরী জেলায় বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। বিএনপির দলীয় কোন্দল ও বিরোধে নগরীর লালখান বাজার, জেলার রাউজান, মীরসরাই ও সীতাকুন্ড ৪জন খুন হয়েছেন। নগরীর বাকলিয়ায় সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ ও সারোয়ার গ্রুপের বিরোধে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে। চলন্ত প্রাইভেট কারকে ধাওয়া করে মোটরসাইকেল থেকে সিনেমা স্টাইলে ওই জোড়া খুনের ঘটনায় কমপক্ষে ১০টি অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

এর পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক কলহ বিরোধে আরো বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ৮ এপ্রিল, মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রামের চন্দনাইশে নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে খুন হন কলেজ ছাত্রী আরজু আকতার (২০)। ঘটনা দেখে ফেলায় নানা আবদুল হাকিম (৭৫) ও নানী ফরিদা বেগমকে (৬০) এলোপাথারি কুপিয়ে জখম করা হয়। আরজুর খুনি তারই ১ নিকট আত্মীয় নাজিম উদ্দিন (২৭)। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে নাজিম উদ্দিন নামে ওই যুবক আরজুকে যৌন নির্যাতন করতে চাইলে আরজু বাধা দেয়। তাই তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। আর ঘটনা দেখে ফেলায় আরজুর নানা-নানীকে কুপিয়ে আহত করা হয়।

ফটিকছড়ির ভুজপুরে মা-ছোট ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করে এক যুবক। এই ঘটনায় ৭ এপ্রিল উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের টিল্যাপাড়া পাহাড় এলাকা থেকে বড় ভাইকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার মো. ইয়াছিন (৪০) ফটিকছড়ির ভূজপুর ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ফকিরা বন এলাকার ভোলা গাজীর বাড়ির বাসিন্দা। ৩ এপ্রিল তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছোট ভাই মো. মাসুমের (৩৫) সঙ্গে বাকবিতন্ডা হয় ইয়াছিনের। এক পর্যায়ে মাসুমকে দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করেন ইয়াছিন। ঝগড়া থামাতে গেলে ইয়াছিন তার মা জুলেখা খাতুনকেও (৫৮) কুপিয়ে জখম করেন। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠালে ৪ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাসুম মারা যান। এরপর ৬ এপ্রিল মারা যান জুলেখা খাতুন।

রাউজানে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে সৎভাইদের হাতে খুন হন এক প্রকৌশলী। তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ১ এপ্রিল উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের তীতা গাজীপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। খুনের শিকার মুহাম্মদ নুরুল আলম (৪০) আলম একই এলাকার বাসিন্দা। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন তীতা গাজীপাড়ার দিদারুল আলম ও নজরুল ইসলাম, যারা নুরুল আলমের সৎভাই। বোয়ালখালী উপজেলায় ছেলের কাঁচির আঘাতে আহত বাবা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ৮ এপ্রিল। নিহত আজিজুল হকের (৬৬) বাড়ি বোয়ালখালী পৌরসভার পূর্ব গোমদন্ডী এলাকায়। এ ঘটনায় পুলিশ তার ছেলে সাজ্জাদ হোসেন আসিফকে (২২) গ্রেফতার করে। পুলিশ জানায়, ৪ এপ্রিল নিজ বাড়িতে সাজ্জাদের কাঁচির আঘাতে গুরুতর আহত হন আজিজুল হক।

গত ৫ এপ্রিল নগরীতে স্ত্রীকে ছুরিকাঘাত করে খুনের ঘটনায় স্বামীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পারিবারিক কলহের জেরে তিনি স্ত্রীকে খুন করেছেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। গ্রেফতার সবুজ খন্দকার (২৯) টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলারে বাসিন্দা। তিনি নগরীর বন্দর থানার ধুমপাড়া সাগর রোড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ৪ এপ্রিল বন্দরের বাকের আলী টেকের মোড় এলাকায় চাঁদনি খাতুনকে (২৫) এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে পালিয়ে যান তার স্বামী সবুজ খন্দকার। পুলিশ জানায়, চাঁদনি সবুজের সঙ্গে আর সংসার করতে চাচ্ছিলেন না। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার ঝগড়াও হয়। এর জের ধরে তাকে রাস্তায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে সবুজ।

বিয়েবর্হিভূত সম্পর্ক তথা লিভটুগেদারের জেরেও খুনের ঘটনা ঘটছে। গত ২৬ মার্চ রাতে নগরীর বন্দর থানার কলসি দিঘীর পাড় এলাকায় একটি ভবনে তালাবদ্ধ বাসা থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন রাতে ঢাকার পোস্তগোলা থেকে ইব্রাহিম হাওলাদার (২৪) নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে ডিবি। ইব্রাহিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিহত নারীর নাম-পরিচয়সহ বিস্তারিত তথ্য পায় ডিবি। তার নাম টুম্পা আক্তার (২২)। তার বাবার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। তিনি নগরীর সিইপিজেডে প্যাসিফিক জিনস কারখানায় কর্মরত ছিলেন। পুলিশ টুম্পার সঙ্গে তার স্বামীর ছাড়াছাড়ি হয়। সেই সংসারের চার বছর বয়সী এক ছেলে নিয়ে সে কলসি দিঘীর পাড়ে ভাড়া বাসায় থাকতো। সেখানে স্বামী পরিচয় দিয়ে ইব্রাহিমকে সে সঙ্গে রেখেছিল। বিয়েবর্হিভ‚ত সম্পর্ক কন্টিনিউ করতে গিয়ে তাদের মধ্যে নানা কারণে মনোমালিন্য হয়। এর জের ধরে তাকে খুন করে ইব্রাহিম।

তার আগে নগরীর লালখান বাজার থেকে এক মহিলার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার নাম জ্যোৎস্না বেগম (৩০)। এই ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় তার প্রেমিক নয়ন বড়ুয়াকে (৩২)। পুলিশ জানায়, নয়ন বড়ুয়া ও জ্যোৎস্না বেগম উভয়ই নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকার কেডিএস গার্মেন্টেসে কর্মরত ছিলেন। এ সুবাদে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নয়ন বিবাহিত, তার দুই সন্তান আছে। জ্যোৎস্নার বিয়ে হয়েছিল। তবে গত বছর স্বামীর সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়। ফেব্রæয়ারি মাসে নগরীর বন্দরটিলা এলাকায় একটি ভবনে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে নয়ন ও জ্যোৎস্না একটি বাসা ভাড়া নেন। স¤প্রতি জোৎস্না বেগম নয়ন বড়ুয়াকে ধর্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করার জন্য চাপ দিলে তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানান। এই নিয়ে বিরোধের জেরে জোৎস্নাকে গলাটিপে হত্যা করেন নয়ন বড়ূয়া। পরে বস্তাবর্তি লাশ ফ্লাইওভারের নিচে ফেলে যাওয়া হয়।

তুচ্ছ ঘটনায়ও প্রাণ যাচ্ছে। আনোয়ারা উপজেলায় পাওনা টাকা নিয়ে বিরোধে জেরে ১৪ মার্চ ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় মো. মানিক নামে ১ যুবককে। পরদিন রাউজানে তর্কাতর্কির জেরে খুন হন কমর উদ্দিন নামে ১ বিএনপি নেতা। এর আগে ১১ মার্চ নগরীর ইপিজেড এলাকায় পরকীয়ার সন্দেহে বন্ধুর হাতে খুন হন মোহাম্মদ আইয়ুব নবী নামে ১ যুবক। একই দিন আনোয়ারা উপজেলায় টিউবওয়েলের পানি নিষ্কাশনের জন্য পাইপ স্থাপন নিয়ে বিরোধে বড়ভাইয়ের হাতে খুন হন সালামত আলী নামে এক ব্যক্তি। ৯ মার্চ আনোয়ারায় মেয়ের স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন রশিদা খাতুন নামে ১ নারী। ৩ মার্চ সাতকানিয়ায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে গণপিটুনি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় ২ জামায়াত কর্মীকে।ই

মন্তব্য করুন