৬ মাসে পুলিশের ওপর ২৩০ হামলা স্টাফ রিপোর্টার

অনলাইন ডেস্ক : চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী শাহীন আলম। রাজধানীর তেজগাঁও থানার টহলরত পুলিশ সদস্যরা মাদক বিক্রি করতে দেখেন তাকে। এ সময় শাহীনকে কাওরান বাজার থেকে পুলিশ সদস্যরা গ্রেপ্তার করে। তখন সে পালানোর চেষ্টায় চিৎকার দিয়ে অন্য মাদক ব্যবসায়ীদের একত্র করে। তারা দেশীয় অস্ত্র চাপাতি ও ছুরি দিয়ে পুলিশের টহলদলের ওপর হামলা করে আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তাদের হামলায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেন। পরবর্তীতে ঘটনায় জড়িত প্রধান দুই আসামি শাহীন আলম ও দীন ইসলাম কালুকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। র‌্যাব জানায়, শাহীন আলম কাওরান বাজার এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। তার নেতৃত্বে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা ও ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

শুধু কাওরান বাজারের ঘটনাটি নয়, সম্প্রতি পুলিশের ওপর হামলার বেশক’টি ঘটনা ঘটেছে রাজধানীসহ সারা দেশে। দুষ্কৃতকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। সড়কে ট্রাফিকে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা কেউ কেউ বিরূপ আচরণ ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। শুধু পুলিশ বাহিনী নয়, অপরাধ দমাতে গেলে হামলার শিকার হচ্ছেন অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরাও। কোথাও কোথাও আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। আবার কোথাও কোথাও থানায় গিয়ে আসামি ছাড়িয়ে নিতে মব তৈরি করছে দলবদ্ধ হয়ে। এ সব হামলার পিছনে উচ্ছৃঙ্খল জনতা, পেশাদার অপরাধী, মাদক ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দায়িত্ব পালনকালে গত ছয় মাসে পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার ২৩০টি ঘটনা ঘটে। গত বছরের আগস্টে ৪১টি, সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৩৪টি, নভেম্বরে ৪৯টি, ডিসেম্বরে ৪৪টি এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৩৮টি। এর আগে গত বছরের জানুয়ারিতে হামলার ঘটনা ঘটে ৪৩টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭টি, মার্চে ৪৩টি, এপ্রিলে ৭৯টি, মে ৪৩টি, জুনে ৩৬টি এবং জুলাই মাসে ১৭০টি। এর আগে পাঁচ বছরে হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালে ৫৫৫টি, ২০২০ সালে ৪৪৯টি, ২০২১ সালে ৬০৮টি, ২০২২ সালে ৬০১টি এবং ২০২৩ সালে ৬০৭টি। গত ছয় বছরে ৩, ৪৬৩টি হামলার ঘটনা ঘটে।

পতেঙ্গায় ‘মব’ তৈরি করে পুলিশ সদস্যকে মারধর: চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় আউটার রিং রোডে চেকপোস্টে গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি মব তৈরি করে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য ইউসুফ আলীকে মারধরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পরিচালক) ফয়সল হাসান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঘটনার দিন মব সৃষ্টিকারী দু’জনকে তৎক্ষণাৎ পুলিশে সোপর্দ করে জনতা। এর আগে খবর পেয়ে সৈকত এলাকায় টহলরত পতেঙ্গা থানার পুলিশের একটি দল ও আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে গিয়ে উপ-পরিদর্শক (এসআই) ইউসুফকে উদ্ধার করেন। ১লা মার্চ রাতভর অভিযান চালিয়ে এ ঘটনায় জড়িত আরও ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশকে হেনস্থার ঘটনায় পতেঙ্গা থানায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত ত্রাস সৃষ্টি করে এসআই ইউসুফকে হেনস্থাসহ মুঠোফোন, মানিব্যাগ ও ওয়াকিটকি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় জড়িত। তারা মাদক সেবন ও ছিনতাইয়ে জড়িত।

রাজবাড়ীতে পুলিশ পিটিয়ে আসামি ছিনতাই: রাজবাড়ীতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওপর হামলা করে মাদক মামলার এক আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় আহত হন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়াহিদুল হাসান। গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নে কাজীবাধা গ্রামে ঘটনাটি ঘটে।

আসামি ছিনিয়ে নিতে নিউমার্কেট থানায় হামলায় ৫ পুলিশ আহত: রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মোহাম্মদ হোসাইন ওরফে মিথুন নামে এক ছাত্রদল নেতাকে গ্রেপ্তার করে নিউ মার্কেট থানা পুলিশ। আটককৃত মিথুনকে বহনকারী পুলিশের গাড়ি নিউমার্কেট থানা প্রাঙ্গণে প্রবেশকালে বাধা দেন মিথুনের সমর্থকরা। ছাত্রদল নেতা মিথুনকে পুলিশের হেফাজত থেকে ছিনিয়ে নিতে থানায় হামলা করে প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্রদল-যুবদল নেতাকর্মী। হামলায় নিউ মার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) তারিক লতিফসহ পাঁচ জন পুলিশ কর্মকর্তা গুরুতর আহত হন।

তিন ছাত্রকে ছাড়িয়ে নিতে উত্তরায় থানায় হামলা: উত্তরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আয়োজিত এক সভা থেকে আকাশ, রবিন ও বাপ্পি নামের তিন শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা প্রথমে উত্তরা-পূর্ব থানা ঘেরাও করে। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে উত্তরা পশ্চিম থানায় হামলা চালিয়ে পুলিশের ওপর চড়াও হয় তারা। হামলার সময় থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মহাদেব মারধরের শিকার হন।

মোহাম্মদপুরে পুলিশের ওপর কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত ৪: গত ৫ই ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় পুলিশের তিন উপ-পরিদর্শকসহ (এসআই) চার পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন। পরে যৌথ বাহিনীর অভিযানে ওই এলাকা থেকে বেশক’জন গ্রেপ্তার হয়। সম্প্রতি রংপুরে এক কর্মশালায় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের কারণে পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে মানুষের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ৫ই আগস্ট পরবর্তী অপরাধী পুলিশ সদস্যদের বিচারের আওতায় এনে ও সরিয়ে দিয়ে পুলিশ বাহিনীকে সগৌরবে ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। নাগরিক সমাজের প্রতি আমার অনুরোধ, পুলিশকে আপনারা আবার কাছে টেনে নিন। পুলিশকে কাজ করতে সহায়তা করেন। দেশে বিভিন্ন জায়গায় দেখা গেছে, পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে মানুষের আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ৫ই আগস্ট পরবর্তী আমরা চেষ্টা করছি যারা অপরাধী তাদের বিচারের আওতায় এনে ও সরিয়ে দিয়ে পুলিশকে আবার সগৌরবে ফিরিয়ে আনা, কর্মক্ষম করে তোলা, পুলিশকে আবার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা।
পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মতিউর রহমান শেখ এবং সাধারণ সম্পাদক ও মো. আনিসুজ্জামান বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও আইন অমান্যকারী ব্যক্তির অসৌজন্যমূলক আচরণের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে গভীর উদ্বেগ-নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। বাংলাদেশ পুলিশ দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, নাগরিকদের নিরাপত্তা, অপরাধ চিহ্নিত ও দমন করে সুশৃঙ্খল সমাজ বিনির্মাণে পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে কিছুসংখ্যক উচ্ছৃঙ্খল, ক্ষমতালিপ্সু, অসৎ, অপেশাদার কর্মকর্তার কারণে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তবে বর্তমানে পুলিশ বাহিনী নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নতুন উদ্দীপনায়, চেতনায় ও আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করছে। কিছু উচ্ছৃঙ্খল ও শান্তি বিঘ্নকারী ব্যক্তি অযাচিতভাবে পুলিশের কাজে বাঁধা দেওয়ার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। এতে জনমনে অশান্তি, হতাশা সৃষ্টি ও জন শৃঙ্খলা ভঙ্গের মতো পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, বর্তমানে অপরাধের যে সংখ্যা এবং হিংস্র্রভাবে যে অপরাধগুলো হচ্ছে- তার প্রেক্ষাপটে অমরা এটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেয়ে অপরাধীদের শক্তি অনেক বেড়ে গেছে। কোথাও কোথাও পুলিশের ওপরে হামলা হচ্ছে। অপরাধ দমাতে চেষ্টা করলেও অনেক সময় তারা নিজেরা নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে অপরাধপ্রবণতা, ডাকাতি, অপহরণ, সহিংসতা, সংঘাত, খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এই ধরনের অপরাধগুলো অনেক কমে আসার কথা, এটাই আমরা প্রত্যাশা করেছি কিন্তু বাস্তবতা তার বিপরীত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে আমরা যতই আলোচনা-সমালোচনা করি না কেন তাদের উপরেই নির্ভর করতে হয়। পুলিশের ওপর এ ধরনের হামলা-আক্রমণ, আসামি ছিনতাই বাহিনীটিকে নতুন সংকটের মধ্যে ফেলছে। পুলিশের ওপর এ ধরনের হামলা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রভাব পড়বে। পুলিশকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সহযোগিতা করতে হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, কোনো ব্যক্তি যদি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর কোনো বাধার সৃষ্টি করে সেক্ষেত্রে আইনি বিধি অনুযায়ী আমরা মামলা করছি এবং যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। এ ধরনের হামলার ঘটনায় আমরা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। পুলিশিংয়ে ঝুঁকি আছে, অনেক সময় এইরকম পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। আমরা প্রত্যাশা করি জনগণ আমাদের সঙ্গে থাকবেন, সহযোগিতা করবেন।মা:সূ।

মন্তব্য করুন