
খবর অনলাইন :
একদিকে বহির্বিশ্বের চাপ, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরোধিতা। তারপরও মিয়ানমার সামরিক জান্তা দশকের পর দশক টিকে আছে। কিন্তু গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে তাদের অপরাজেয় শক্তিতে ক্ষয় ধরেছে। ২০২১ সালে জান্তা বাহিনী ঝটিকা আক্রমণের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়। ফলস্বরূপ, নতুন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে এবং পুরোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের শক্তি যোগ হয়। ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে বেশ কয়েকটি শহর এবং চার শতাধিক সামরিক ঘাঁটি দখলের মতো অভাবনীয় সফলতা দেখিয়েছে।
তাদের এসব সফলতার পেছনে উল্লেখযোগ্য কোনো আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছিল না। অথচ তারা দীর্ঘকাল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জান্তা বাহিনীর ভিত্তি নড়বড় করে দিয়েছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের গণতান্ত্রিক মিত্র দেশগুলোর উচিত বিদ্রোহীদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করা এবং ভবিষ্যৎ উদার মিয়ানমার সৃষ্টির পদক্ষেপ নেওয়া।
১৯৬২ সালে সামরিক বাহিনী মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করেছিল এবং তখন থেকেই দেশটিতে তারা কর্তৃত্ব করে আসছে। তারা সাংঘাতিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এরই মধ্য দিয়ে জনসাধারণ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে এ দেশের সাধারণ মানুষ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিম্নমানের জীবন যাপন করছে।
ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন একটি উদার ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের পক্ষে তাদের অবস্থান ঘোষণা করেছে। তাদের উচিত মিয়ানমারের বিদ্রোহী জনতার পাশে পরিষ্কার অবস্থান নিয়ে দাঁড়ানো। মিয়ানমার গণতান্ত্রিক হলে ভৌগোলিক কারণে চীন ও রাশিয়ার প্রভাব মোকাবিলায় দেশটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোর (আসিয়ান) মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করতে হবে, যারা চীন ও মিয়ানমারের সঙ্গে নিজেদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে বহুকাল ধরে বিভক্ত হয়ে আছে। এভাবে মিয়ানমার বাইডেন প্রশাসনকে তার অন্যতম লক্ষ্য কর্তৃত্ববাদ রুখতে সহায়তা করতে পারে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার সম্বন্ধে হতাশা ব্যক্ত করছে। তাদের মতে, এদেশে অতীতেও এ ধরনের বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোকে নির্মূল করা হয়েছে। তা ছাড়া তাদের সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীগুলোর বিভাজন দূর করাও অসম্ভব। ফলে সত্যিকার গণতান্ত্রিক অগ্রগতি এখানে বাধাগ্রস্ত হবেই। এভাবে দেখলে বলতে হয়, একমাত্র জান্তাই মিয়ানমারের ভাঙন রুখতে পারে। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিদ্রোহী জনতা সামরিক জান্তাকে পরাজিত করতে পারবে কিনা এবং পরবর্তী সময়ে তাদের মনোভাবই বা কেমন হবে– এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও উদ্বিগ্ন।
তবে বিদ্রোহীদের সফলতা দেখে বোঝা যায়, এসব অনুমান এড়িয়ে যেতে হবে। এটি সত্য যে, অস্ত্র, গোলাবারুদ, যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য সরঞ্জামের দিক থেকে সামরিক বাহিনী বিদ্রোহী জনতার চেয়ে এগিয়ে আছে। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন ফ্রন্টে জান্তা বাহিনী বেশ চাপের মুখোমুখি এবং সেনাবাহিনীর মনোবলের ঘাটতির কারণে দলত্যাগ, যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাওয়ার হার অনেক বেশি। এমনকি পুরো বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, এমন ঘটনাও আছে।
অন্যদিকে, বিদ্রোহী জনতা ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। অক্টোবরের শেষের দিকে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো আধা ডজনের বেশি অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। তাদের এ ধরনের সামরিক সক্ষমতা আগে দেখা যায়নি। এতে তাদের অবস্থানও ভারসাম্যপূর্ণ বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
বর্তমানে মিয়ানমারের সংঘর্ষ একটি যৌথ প্রচেষ্টার রূপ নিয়েছে। সব সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী সংঘবদ্ধ হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ এই বামার নৃগোষ্ঠী মূলত সামরিক বাহিনীর মধ্যকার অতি জাতীয়তাবাদী ক্ষুদ্র একটি অংশ, যারা স্বদেশের বৈচিত্র্য ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করছে।
সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের পর থেকে বিপ্লবী আন্দোলনগুলো আলাদাভাবে জোটবদ্ধ হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে অং সান সু চির রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য জোট, সুশীল সমাজের মেম্বার, দশকের পর দশক সামরিক জান্তাবিরোধী সশস্ত্র নৃগোষ্ঠী বাহিনী ও নতুন প্রজন্ম, যারা মিয়ানমারে সত্যিকার গণতন্ত্রের আশায় লড়ে যাচ্ছে।
গত বছর পাস হওয়া বার্মা অ্যাক্টের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহীদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ রাখে। অ্যাক্ট অনুসারে মিয়ানমার গণতন্ত্রের পক্ষে সমর্থন পাওয়ার আহ্বান জানাতে পারে এবং সামরিক অভ্যুত্থান ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, গণতন্ত্রপন্থি গোষ্ঠীদের বেসামরিক সহযোগিতা প্রদান এবং প্রয়োজনে কংগ্রেস যথাযথ তহবিল সরবরাহ করতে পারে।
ওয়াশিংটনের অবশ্যই বার্মা অ্যাক্টের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে বিদ্রোহীদের সফলতা নিশ্চিত করতে সহায়তা দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে প্রতিবেশী থাইল্যান্ড ও ভারতকে সীমান্তের ওপারে বিদ্রাহীদের আরও বেশি সুবিধা দিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। চীনকেও এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বোঝানো উচিত– এই জান্তা বাহিনী সব ধরনের অস্থিতিশীলতার কারণ। সুতরাং বিপ্লব সফল করতে বেইজিংকেও যুক্তরাষ্ট্র উৎসাহ দেবে।
ইয়ে মিও হেইন: মিয়ানমারের রাজনীতি বিশেষজ্ঞ; লুকাস মিয়ার্স: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞ; নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম। স