মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত জীবনের ১৭ বছর অতিক্রম এম.কে.জাকির হোসাইন বিপ্লবী

প্রীয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ, সৃষ্টিকর্তার পরেই প্রদর্শনের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন।মা এক অমূল্য রত্ন।যা কখনো খরিদ করা যায় না। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার উপর যদি কোন শ্রেষ্ঠ নেয়ামত থাকে, তাহলে সে নেয়ামত হচ্ছে মা। পৃথিবীতে সব শূন্যতার অভাব পূরণ হলেও,মায়ের শূন্যতা কখনো পূরণ হয় না। আলো ছাড়া পৃথিবী যতটা মূল্যহীন হয়ে পরে,মা ছাড়া প্রতিটা সন্তানের জীবন ঠিক তেমনেই মূল্যহীন। মায়ের অনুপস্থিতি হৃদয়ে এক অপ্রকাশিত ব্যথার পাহাড়। যেই ব্যাথা বোঝার ক্ষমতা আসমানের নিচে জমিনের উপরে কারো নেই। একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই সেই ব্যতীত হৃদয়ে, কিছুটা প্রসন্ন দান করতে পারেন। মা শুধুই মা, তার কোন তুলনা হয় না। মায়ের সম্মানার্থে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর দেখানো পথ, বিশ্ব মানবতার জন্য শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। হযরত হালিমা সা’দিয়া (রাজিঃ) ছিলেন প্রিয় নবীর দুধমাতা। ওনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে শিশু অবস্থায় দুধ পান করিয়েছিলেন এবং ওনার স্নেহময় যত্নে লালন-পালন করেছিলেন। হাদিসে ওনার সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়।

হাদিসে হযরত হালিমা সা’দিয়ার সম্মান
রাসূলুল্লাহ (সা.) তার দুধমাতা হযরত হালিমা সা’দিয়া (রাযি.)-কে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। নিম্নে একটি প্রাসঙ্গিক হাদিস উল্লেখ করা হলো:
১. হালিমা সা’দিয়ার সঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ইবনে ইসহাক (রহ.) বর্ণনা করেন, একবার হযরত হালিমা (রাযি.) মক্কায় রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে খুব সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেন। তার জন্য নিজের চাদর বিছিয়ে দেন এবং তার সঙ্গে স্নেহপূর্ণ কথাবার্তা বলেন।
২. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কৃতজ্ঞতা রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো তার দুধমাতার প্রতি অকৃতজ্ঞতা দেখাননি। তিনি সবসময় তার প্রতি দোয়া করতেন এবং তার মর্যাদা বজায় রাখতেন।
কুরআনের দৃষ্টিতে দুধমাতার সম্মান
আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমাদের মায়েরা, যারা তোমাদের দুধ পান করিয়েছে, এবং দুধের মাধ্যমে তোমাদের বোন হয়েছে—তাদের সঙ্গে বিবাহ হারাম করা হয়েছে।” (সূরা আন-নিসা: ২৩)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, দুধমাতা একজন মায়ের মতোই মর্যাদা রাখেন।
হযরত হালিমা সা’দিয়া (রাযি.) ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তার স্নেহময় আচরণ ও যত্ন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনের শৈশবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবদ্দশায় ওনার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়েছেন, যা আমাদের জন্য একটি শিক্ষা যে, আমাদের জীবনে যারা যত্ন এবং স্নেহ দিয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রদর্শন করা আমাদের কর্তব্য।
দুধমাতা হযরত হালিমা সা’দিয়া (রাজিঃ) এর প্রতি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর সম্মানের যে বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, উক্ত বিষয়গুলোর আলোকে স্পষ্ট প্রমাণিত, পৃথিবীতে মায়ের সাথে কারো তুলনা হয়না। মায়ের সম্মান অতুলনীয়, যা মহাপ্রভুর পরেই মায়ের প্রতি সম্মানীয় আচরণের কথা বলেছেন প্রিয় নবী (সাঃ)। আর সেই মায়ের স্নেহ ভালোবাসা থেকে, যে সন্তান বঞ্চিত হয়েছে, তার ভিতরে যে প্রকাশিত ছাপা কান্না অতিবাহিত হচ্ছে, যা বোঝার ক্ষমতা কেউ রাখে না।

মা সন্তানের মুখ দেখার পর পরেই, সন্তানের কষ্ট অনুভব করতে পারেন, যা আর কেউ পারে না। ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখ দেখেই, মা অনুভব করতে পারেন সন্তান না খেয়ে আছেন।সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা অতুলনীয়। যা লিখে প্রকাশ করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। প্রতিটা সন্তানের জীবনেই মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা ও মমতা সন্তানের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এমন অনেক সন্তান আছে, যাদের জীবনে এই আশীর্বাদ আর পাওয়া হয়নি। আমি তাদের একজন। জীবনের ১৭টি বছর মাতৃহীন কাটানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে গেলে, এটি নিঃসন্দেহে এক ধ্রুব শূন্যতার গল্প।

মা আমাদের জীবনে কেবল একজন অভিভাবক নন; তিনি আমাদের প্রথম বন্ধু, শিক্ষক, এবং রক্ষাকারী। শৈশবে যখন আঘাত পাই, তখন তার হাতের ছোঁয়া ছিল সান্ত্বনার প্রতীক। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর সেই স্পর্শের অভাব যেন জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে কষ্টে পূর্ণ করে তোলে। ছোটবেলায় মায়ের কোল হারানো মানে হলো এমন এক পৃথিবীতে বেড়ে ওঠা, যেখানে নিরাপত্তার ছায়া নেই।

মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত একটি সন্তানকে বাস্তবতার কঠিন আঘাতগুলো খুব অল্প বয়সেই বুঝতে হয়। জীবনের নানা বাধা-বিপত্তি পেরোতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে, যদি মা থাকতেন, তাহলে এই যন্ত্রণাগুলো হয়তো কম হতো। মায়ের স্নেহের অভাব শুধু মানসিক শূন্যতা নয়, এটি একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস এবং ভবিষ্যত গঠনের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে।
তবে এই দীর্ঘ ১৭ বছরের পথচলায় আমি একটি বিষয় উপলব্ধি করেছি—জীবনের প্রতিটি যন্ত্রণা, প্রতিটি শূন্যতা আমাদের নতুন কিছু শেখায়। মায়ের অভাব আমাকে আরও আত্মনির্ভরশীল এবং দায়িত্বশীল হতে শিখিয়েছে। জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে মায়ের স্মৃতি আমার গাইড হিসেবে কাজ করে। আজও যখন আমি মায়ের কৃতি স্মরণ করে মন খারাপ করি, তখন নিজেকে মনে করাই, মা হয়তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু তার ভালোবাসা, দোয়া এবং স্মৃতি সবসময় আমার সঙ্গেই আছে। আমি জানি, মায়ের প্রতি আমার দায়িত্ব হলো তার স্নেহের অভাব সত্ত্বেও এমন একজন মানুষ হয়ে ওঠা, যে তার স্মৃতিকে সম্মান জানাতে পারে।

মাতৃস্নেহের অভাব জীবনের এক অনন্য ধ্রুব শূন্যতা হলেও, এটি আমাকে জীবনের মূল্য এবং সম্পর্কের গভীরতা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে। মায়ের ভালোবাসা বঞ্চিত জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে শিখিয়েছে, জীবনের প্রতিটি সম্পর্কের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত এবং কঠিন পরিস্থিতিতেও নিজের আদর্শ ধরে রাখা জরুরি।এভাবেই আমি মায়ের স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে জীবন যাপন করছি, তার দোয়া আমার প্রতিটি কাজে পথপ্রদর্শক হয়ে আছে। মা নেই, কিন্তু তার ভালোবাসা আমার হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবে।

মন্তব্য করুন