ভারী বৃষ্টির পানিতে ডুবেছে চট্টগ্রাম

১২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ‘সুফল’ পানিতে পানিবন্দি লাখো মানুষ : পাহাড়ধসের আশঙ্কা

নিজস্ব প্রতিনিধি : থেমে থেমে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণে ফের ডুবেছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। এ নিয়ে চলতি বর্ষা মৌসুমে এবং এর আগে ও পরে ৫ দফায় ডুবলো চট্টগ্রাম মহানগরী। গতকাল মঙ্গলবার দিনভর এবং আগের রাত (সোমবার) থেকে চট্টগ্রামে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবহাওয়া বিভাগ জানায়, বর্ষার বাহক দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু সক্রিয় ও জোরালো থাকায় এবং দেশের মধ্যাঞ্চলে অবস্থানরত লঘুচাপের সক্রিয় প্রভাবে প্রায় সারা দেশে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। আজও বুধবার দেশের অধিকাংশ এলাকায় বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। দেশের কোথাও কোথাও হতে পারে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত। গতকালের অতি বর্ষণে চট্টগ্রাম মহানগরী ও জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে। অতি বৃষ্টির সাথে প্রবল সামুদ্রিক জোয়ারের পানি যোগ হয়ে নগরী ও জেলার উপকূল সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলগুলো তলিয়ে যায়। চট্টগ্রাম নগরীর অনেক এলাকা হাঁটু থেকে বুকসমান পানিতে থৈ থৈ করে। এ সময় নগরীর হাজারো বসতঘর, দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, গুদাম, আড়ত কাদা-পানি-বালুতে সয়লাব হয়ে যায়। রাত অবধি জঞ্জাল সরাতেই নাকাল নগরীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ। আবহাওয়া বিভাগ জানায়, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১১৯ মিলিমিটার।

বৈরী আবহাওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রফতানি পণ্যসামগ্রী খালাস, ডেলিভারি পরিবহন ব্যাহত হয়। সাগর উত্তাল থাকায় চট্টগ্রাম বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে মালামাল লাইটারিং খালাস ব্যাহত হচ্ছে। ভারী বর্ষণে নগরীর বিশেষ করে মুরাদপুর, ষোলশহর, শোলকবহর, বহদ্দারহাট, কাপ্তাই রাস্তার মোড়, সিএন্ডবি, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, কাতালগঞ্জ, পাঁচলাইশ, প্রবর্তক, আগ্রাবাদ, হালিশহর, পতেঙ্গা, পাহাড়তলী, সাগরিকাসহ বির্স্তীর্ণ এলাকায় মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ পোহাতে হয়, যা অবর্ণনীয়। নগরীর প্রধান সড়ক সিডিএ এভিনিউতে রীতিমেতা পানির ঢল বয়ে যায়। কর্মমুখী অগণিত মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। দুপুরের পর বর্ষণ স্তিমিত হলেও সন্ধ্যা নাগাদ আবারও ভারী বৃষ্টি শুরু হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নগরীতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। এদিকে অতি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে অনেক জায়গায় ফল-ফসলি জমি ও শাক-সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে।

গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে সিলেটে ২২১ মিলিমিটার। অব্যাহত বৃষ্টিপাতের ফলে প্রায় সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা হ্রাস পাচ্ছে। গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যশোরে ৩৪ এবং সর্বনিম্ন টাঙ্গাইলে ২৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা ছিল সর্বোচ্চ ৩২.৪ এবং সর্বনিম্ন ২৬.২ ডিগ্রি সে.। চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৯ এবং সর্বনিম্ন ২৫.৫ ডিগ্রি সে.। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকায় কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। ঢাকা, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন স্থানে স্বল্প বৃষ্টিপাত হয়েছে।
১২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প : চট্টগ্রাম মহানগরীর পানিবদ্ধতা সমস্যা নিরসন এবং খাল-ছরা দখলমুক্ত করে সংস্কার, পুনঃখননের লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পে ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে সিডিএ’র মাধ্যমে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ হতে চলেছে। অথচ সিডিএসহ তিনটি সরকারি সংস্থার প্রকল্প চট্টগ্রাম মহানগরীকে পানিবদ্ধতার সেই ‘বারমাইস্যা সমস্যা’ থেকে মুক্ত করতে পারেনি। বরং ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি প্রকল্পের ‘সুফল’ গেছে পানিতে!

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ নাগরিক সেবাদানে নিয়োজিত সরকারি সংস্থাসমূহের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যকার সমন্বয়হীনতার কারণেই মূলত এসব প্রকল্পের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরী পানিবদ্ধতা সমস্যা থেকে মুক্ত হচ্ছে না। নাগরিকরা পাচ্ছেন না এর সুফল। বরং সরকারি অর্থের যথেচ্ছভাবে অপচয়-দুর্নীতি, অনিয়ম হয়ে আসছে। নগরীকে পানিবদ্ধতা মুক্ত করা অর্থাৎ জনস্বার্থ পূরণে ব্যর্থতার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে জববাবদিহিতা ও শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সচেতন নগরবাসী।

এদিকে গতকাল আবহাওয়ার সর্বশেষ সতর্কবার্তায় জানা গেছে, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি অব্যাহত রয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।

আজ বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক জানান, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রংপুর বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। তাছাড়া আরও অন্তত ৫ দিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।

আবহাওয়া বিভাগ জানায়, বর্ষার মৌসুমী বায়ুর একটি বলয় ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে।
ভারী বর্ষণের সতর্কতা : গতকাল আবহাওয়া বিভাগের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ধসের সতর্কতায় জানা গেছে, দেশের মধ্যাঞ্চল ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপ এবং মৌসুমী বায়ুর সক্রিয় প্রভাবে ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও গতকাল থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় ভারী (২৪ ঘণ্টায় ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত) থেকে অতি ভারী (২৪ ঘণ্টায় ৮৯ মিলিমিটারের ঊর্ধ্বে) বর্ষণের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।ই

মন্তব্য করুন