
সিইসির কাছে চট্টগ্রামের ১৬ আসনের প্রার্থীরা যা বললেন
খবর ডেস্ক :
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আওয়ালকে কাছে পেয়ে চট্টগ্রামের ১৬ আসনের প্রার্থীরা তাদের নানা অভিযোগের কথা তুলে ধরেছেন। বেশ কয়েকটি আসনের নৌকার প্রার্থী স্বতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ করেছেন।
আসনভিত্তিক প্রার্থীর নির্বাচনী পরিবেশসহ অভিযোগের কথা শুনতে চান সিইসি। এ সময় প্রার্থীরা দাঁড়িয়ে তাদের নির্বাচনী এলাকার নানা অভিযোগ, সমস্যা এবং আশঙ্কার কথা জানান সিইসিকে। প্রার্থীদের অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগের পর সিইসি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের গণসংযোগে বাধা, ভয়–ভীতি প্রদর্শনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পুলিশ প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন। এছাড়া সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারসহ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা, প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে নগরীর এলজিইডি ভবন মিলনায়তনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া চট্টগ্রামের ১৬ আসনের প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। সভায় কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সভায় উপস্থিত একাধিক প্রার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে সিইসির কাছে চট্টগ্রাম–১৫ সাতকানিয়া–লোহাগাড়া আসনের নৌকা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী, চট্টগ্রাম–১৬ বাঁশখালী আসনের নৌকা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর অনুপস্থিতিতে দুই প্রার্থীর দুই সমর্থক সবচেয়ে বেশি অভিযোগ করেছেন। এছাড়া চট্টগ্রাম–১২ পটিয়া আসনের নৌকা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে, চট্টগ্রাম–১ মীরসরাই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে, চট্টগ্রাম–৩ সন্দ্বীপ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে, চট্টগ্রাম–২ ফটিকছড়ি আসনের নৌকার প্রার্থী স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরুদ্ধে, চট্টগ্রাম–১০ ডবলমুরিং আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর সঙ্গে ঈগল ও ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নানা অভিযোগ করেন সিইসিকে। আসনভিত্তিক অভিযোগ শোনার পর সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সভায় উপস্থিত স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে তাৎক্ষণিক নির্দেশনা দেন।
চট্টগ্রাম–১২ পটিয়া আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, আমি সংঘাত–সহিংসতা চাই না। আমি চাই এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করা হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে ভোট চেয়েছেন, উৎসবমুখর পরিবেশে জনগণ লাইন ধরে ভোট দেবেন, সেই ভোট আমি চাই। কিন্তু আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী নিজেই গুণ্ডা নিয়ে যেভাবে রাস্তায় নেমে প্রচার করছেন, যেভাবে তিনি আমার অফিস–ক্যাম্প ভাঙচুর করছেন, পোস্টার–ব্যানার ছিঁড়ে ফেলছেন; ভোটারদের মাঝে একটা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করছেন। যেখানে তিনি গণসংযোগে যাচ্ছেন সেখানেই ঈগলের পোস্টার–ব্যানার ছিঁড়ে ফেলছেন। সেটাই কি নির্বাচন? তিনি চাচ্ছেন যেনতেনভাবে পাস করবেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন ২০০ ভোট পেলেও তাকে ঘোষণা করা হবে। তিনি চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে তিনি কি চান। তিনি সন্ত্রাসী দিয়ে ভোট চান।
পটিয়া আসনের নৌকার প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে বলেছি, আমার সাথে যিনি প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী, হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, তিনি নিজের পছন্দমতো পটিয়া থানায় পুলিশের একটি সেটআপ করে গেছেন। তিনি হয়তো জানতেন তিনি নমিনেশন পাবেন না। ওসি নেজামুদ্দিন, সেকেন্ড অফিসার সোলায়মান, এসআই সঞ্জয়, এরা ইচ্ছেকৃতভাবে আমাদের নৌকায় যারা কাজ করছেন তাদেরকে হয়রানিমূলক মামলা দিচ্ছেন। আমাদের কর্মী–সমর্থদের গ্রেপ্তার করছেন। গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছেন। আমি চাই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। আমাদের কর্মী–সমর্থকদের অযথা যেন হয়রানি করা না হয়।
চট্টগ্রাম–১৫ সাতকানিয়া–লোহাগাড়া আসনে নৌকার প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকা চরতিতে আমার স্ত্রীসহ নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রচারণা চলাকালে স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবের কর্মী–সমর্থকরা হামলা চালিয়েছে। এই হামলার মূল হোতাদের প্রশাসন এখনো গ্রেপ্তার করেনি। তিনি এর সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
নদভীর বক্তব্যের জবাবে সভায় উপস্থিত চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ বলেন, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। এই পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরো যারা জড়িত তাদের গ্রেপ্তারের অভিযান চলছে।
আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর অভিযোগের পর স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবের পক্ষে উপস্থিত সাতকানিয়ার পৌর মেয়র মোহাম্মদ জোবায়ের নদভীর বিরুদ্ধে সরকারি গানম্যান দিয়ে প্রকাশ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী এম এ মোতালেবের কর্মী–সমর্থকদের প্রাণনাশের হুমকি, ক্যাম্প ভাঙচুর এবং হামলার অভিযোগ করেন। এ সময় দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়।
চট্টগ্রাম–১ মীরসরাই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকায় আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার প্রার্থীর কর্মী–সমর্থকরা আমার নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর করেছে। আমার কর্মী–সমর্থকদের ভয়–ভীতি দেখানো হচ্ছে। নৌকার প্রার্থী প্রশাসনকে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছে। তিনি সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সিইসির কাছে আহ্বান জানান। তবে এখনো পর্যন্ত ভোটের পরিবেশ ভালো আছে বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রাম–৩ সন্দ্বীপ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরী অভিযোগ করেন, নৌকা প্রার্থীর ইন্দনে তার কর্মী–সমর্থকদের মারধর করা হচ্ছে, প্রচার–প্রচারণায় বাধা দেওয়া হচ্ছে। তার প্রস্তাবকের হাত ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম–১০ ডবলমুুরিং আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ফরিদ মাহমুদ তার পোস্টার–ব্যানার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ করেন।
চট্টগ্রাম–১৪ চন্দনাইশ আসনে ইসলামী ফ্রন্টের প্রার্থী সেহাব উদ্দিন মাহমুদ আবদুস সামাদ অভিযোগ করেন, তার নির্বাচনী এলাকায় দুই প্রার্থী নৌকার নজরুল ইসলাম চৌধুরী এবং স্বতন্ত্র আবদুল জব্বার ভোটের মাঠকে সংঘাতময় করে তুলেছেন। তিনি নির্বাচনী মাঠের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে আহ্বান জানান।
চট্টগ্রাম–২ ফটিকছড়ি আসনে সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদ মাইজভান্ডারী বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকার জনগণ যাতে সুষ্ঠুভাবে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারে আমি সেই দাবি করছি।
ফটিকছড়ি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খাদিজাতুল আনোয়ার সনি বলেন, আমি এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে। আমার বাবা এই আসন থেকে বারবার নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমাকে পেয়ে এলাকার মানুষ ভীষণ খুশি। নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু নৌকার কর্মী–সমর্থকদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করা হয়েছে। আমি নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের কাছে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার আহ্বান জানাই।
চট্টগ্রাম–১৪ চন্দনাইশ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আবু জাফর মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ বক্তব্য দিতে দাঁড়ান। কিন্তু বক্তব্য রাখতে নভ পেরে রাগ করে সভা থেকে বেরিয়ে যান।
চট্টগ্রাম–৮ বোয়ালখালী আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সোলায়মান আলম শেঠ বলেন, বিভিন্ন এলাকায় আমার কিছু পোস্টার ও ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।
বৈঠকে সিইসি নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলতে প্রার্থীদের প্রতি অনুরোধ করেন। প্রার্থীদের অভিযোগ যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর দেওয়ার পরামর্শ দেন। অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়ে তিনি বলেন, কোনো প্রকার অবৈধ হস্তক্ষেপ, অযাচিত কর্মকাণ্ড শক্ত হাতে প্রতিহত করা হবে।
পরে চট্টগ্রাম–৪ সীতাকুণ্ড আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী লায়ন মোহাম্মদ ইমরান বলেন, আমি ঈগল প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। এখনো পর্যন্ত নির্বাচনী পরিবেশ মোটামুটি ভালো আছে। আমাদের পরিবার দীর্ঘদিন থেকে সুখে–দুখে এলাকার মানুষের পাশে আছে। এলাকার মানুষের উৎসাহ–ভালোবাসায় প্রার্থী হয়েছি। যেখানে যাচ্ছি মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। আশা করছি এলাকার মানুষ সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারলে ঈগলকেই বেছে নেবেন।
ওই আসনের নৌকার প্রার্থী এস এম আল মামুন বলেন, আমার আসনে একটি উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হবে। ভোটাররা ভোট দেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। আমাদের কোনো প্রার্থী পরস্পরের বিরুদ্ধে এখনো কোনো অভিযোগ দেননি।
চট্টগ্রাম–১১ (বন্দর–পতেঙ্গা) আসনে নৌকার প্রার্থী এম এ লতিফ সিইসির সঙ্গে মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ নৌকার বিরুদ্ধে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষ নিয়েছেন। তা নিয়ে আমি শঙ্কিত নই। তবে কেটলি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী–সমর্থকরা বিভিন্ন স্থানে আমার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে। বিষয়টি আমি প্রশাসনকে জানিয়েছি।
তবে আসনটির কেটলি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী চসিক কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন বলেন, নৌকার প্রার্থী বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণায় গিয়ে আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গালিগালাজ করছেন। আমার কর্মী–সমর্থকদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন। বিষয়টি লিখিতভাবে রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানিয়েছি।
চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার ও রিটার্নিং অফিসার মো. তোফায়েল ইসলামের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন নির্বাচন কমিশনের সচিব জাহাংগীর আলম, রিটার্নিং অফিসার ও জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নুরে আলম মিনা, চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ প্রমুখ।