কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ৬২ মামলা বিচার শেষ হয়নি একটিরও

খবর ডেস্ক :
ঢাকার বিভিন্ন থানায় কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৬২ মামলা দায়ের করা হয়। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলে সহায়তা, উত্ত্যক্ত করা, যৌন হয়রানি, হামলা, মারধরসহ নানান অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে এসব মামলা করা হয়। বর্তমানে কোনো মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ এবং কোনোটি যুক্তিতর্ক পর্যায়ে রয়েছে। বিচার শেষ হয়নি একটিরও।

আদালত সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় সবচেয় বেশি মামলা হয়েছে মিরপুর বিভাগে। এ বিভাগের ৭টি থানায় মামলা হয়েছে ১৮টি। সবচেয়ে কম ওয়ারী বিভাগে। এ বিভাগে মাত্র ১টি মামলা হয়েছে। আর গুলশান বিভাগে ১টি মামলাও নেই। এছাড়াও রমনায় ৪টি, লালবাগে ৭টি, মতিঝিলে ৯টি, তেজগাঁওয়ে ৮টি এবং উত্তরা বিভাগে ১৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ২৭১ জনকে। তদন্তাধীন রয়েছে ৬টি মামলা। চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে ২টির এবং আদালতে বিচারাধীন ৫৪ আর রায়ের পর্যায়ে রয়েছে ২টি মামলা।

এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক হাতিয়ারে রূপান্তরিত হয়েছে। অন্য যেগুলো অপরাধ, যেগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই-সেসব অপরাধে সাক্ষী জোগাড়ে পুলিশের গাফিলতি আছে। সাক্ষী হাজির করা পুলিশের কাজ। পুলিশ এখানে গাফিলতি করছে এবং এ ব্যাপারে তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। সাধারণ অপরাধের ব্যাপারে পুলিশ ঢিলেঢালাভাবে চলে। ফলে সাক্ষী হাজির হয় না এবং মামলায় দীর্ঘসূত্রতা হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের প্রধান উপকমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন বলেন, আদালতে সাক্ষী হাজির করার ব্যাপারে পুলিশ তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করছে। আর এখন সাক্ষীদের নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর অটোমেশনে চলে আসছে। যেদিন যার সাক্ষ্য থাকে, কোর্ট পুলিশ তাকে জানায়। না এলে তাকে সমন দিয়ে ধরে নিয়ে আসা হয়।

তিনি বলেন, এখন সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণের যে তৎপরতা, এটা আগের থেকে বেড়েছে। কিন্তু আদালত মামলার শুনানি শেষ করে রায় দেবে, এটাতে দীর্ঘসময় লাগে। এর কারণ হচ্ছে, মামলা লাখ লাখ; কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা কম। ফলে মামলার বিচার শেষ হচ্ছে না।

তবে সমাজবিজ্ঞানী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কেএম সুজাউদ্দিনের মতে, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের শুধু গ্রেফতার করে জেলে পাঠালেই এ সমস্যার সমাধান হবে না।

তিনি বলেন, কিশোর গ্যাং কেন, কী কারণে ও কীভাবে গড়ে উঠেছে, এর মূলে যেতে হবে। এ অপরাধ নির্মূলে প্রথাগত প্রক্রিয়ার পরিবর্তে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। তাদের জন্য জেলে আলাদাভাবে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এদের প্রতিরোধ করতে না পারলে পরিবার ও সমাজ বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।

বিচারাধীন ৫৪ মামলা : সূত্রাপুরের বাসিন্দা আলাউদ্দিন খন্দকার লঞ্চে কাজ করেন। তার একমাত্র ছেলে আরিফ খন্দকার (১৩) সূত্রাপুর থানাধীন কেএল জুবলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৭ম শ্রেণির ছাত্র। ২০২০ সালের ৩০ আগস্ট পবিত্র আশুরার অনুষ্ঠান শেষে রাত সাড়ে ৯টার দিকে সূত্রাপুর থানাধীন বিবিকা রওজার বিপরীতে রাস্তার ওপর ফুচকা খেয়ে বাসায় রওয়ানা হয়। এ সময় আসামি আরমান (১৩), মো. মন্টি (১৩), রিফাত (১৩), মো সানি (১৩), সজিব (১৩)-সহ অজ্ঞাতনামা ৪/৫ জন লোহার তার, কাচি, লাঠি নিয়ে তার ছেলের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এতে তার ছেলের মাথায় ও বুকের বাম পাশ থেকে নাভি পর্যন্ত গুরুতর জখম হয়। পরে চিৎকার শুনে স্থানীয় লোকজন এসে তার ছেলেকে গুরুতর আহত অবস্থায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করান। পরে তিনি সূত্রাপুর থানায় বাদী হয়ে ১টি মামলা করেন। এ মামলা তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর সজিবকে অব্যাহতি দিয়ে বাকি ৪জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। বর্তমানে ঢাকার নারী শিশু-১ আদালতে এ মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এ মামলায় এখন পর্যন্ত মাত্র ২জন সাক্ষ্য দিয়েছে। ২০২২ সালের ১৩ অক্টোবরের পরে আর কেউ সাক্ষ্য দিতে আসেনি। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এমন অধিকাংশ মামলাই সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আটকে আছে। নিয়মিত সাক্ষী না আসার কারণে এসব মামলায় আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে রমনায় ৩টি, লালবাগে ৭টি, মতিঝিলে ৮টি, ওয়ারী ১টি, তেজগাঁও ৫টি, মিরপুরে ১৬টি এবং উত্তরা বিভাগে ১৪টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।

তদন্তাধীন ৬ মামলা : গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের ১০ শ্রেণির ছাত্র আরিয়ান শহীদকে কিশোর গ্যাংয়ের হামিম হক (১৭), মো. মোর্শেদ আহম্মেদ (১৭), ইমাম হোসেন, তাহসিন আহম্মেদ একোড (১৮), রোহান (১৭), মো. আলামিন মোল্লা (১৮), শুভ (১৮)-সহ অজ্ঞাতনামা ৮/১০ জনের একটি দল বাসার সামনে নামিয়ে দেওয়ার কথা বলে মোটরসাইকেলে করে মিরপুর মডেল থানাধীন মিরপুর-২ পানির ট্যাঙ্ক বটতলা মোড় নিয়ে যায়। পরে দলবদ্ধভাবে লাঠি নিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর, কিলঘুসি ও লাথি মেরে আরিয়ানের ডান চোখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম করে। আসামি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা আরিয়ানের ম্যানিব্যাগে গাঁজা ঢুকিয়ে গাঁজাসেবী হিসাবে আক্ষায়িত করে ভিডিও করে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এ ঘটনায় আরিয়ানের মা আসমা শহীদ বাদী হয়ে মিরপুর মডেল থানায় মামলা করেন। এ মামলা এখনো তদন্তাধীন।

এছাড়াও বিভিন্ন ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে করা মিরপুরে ১টি, তেজগাঁওয়ে ২টি, রমনায় ১টি এবং উত্তরা বিভাগে ১টি মামলা এখনো তদন্তাধীন রয়েছে। এছাড়াও মতিঝিলে ১টি এবং তেজগাঁও বিভাগে ১টি মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে।

বিচারাধীন ও তদন্তাধীন মামলার বিষয়ে ঢাকা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু বলেন, মামলাগুলো সাক্ষ্য ও যুক্তি পর্যায়ে আছে। যেগুলো সাক্ষ্য পর্যায়ে আছে, সেগুলোতে সাক্ষী হাজির করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করছি। আমাদের কোনো গাফিলতি নেই। আমরাও চাই, এ মামলাগুলো দ্রত নিষ্পত্তি হয়ে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হোক।

মন্তব্য করুন