
ডেস্ক : টিকিট সিন্ডিকেটের কাছে ওমরাযাত্রীরা জিম্মি। যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ছাড়াই গ্রুপ টিকিট বুকিং দিয়ে গলাকাটা হারে ওমরাযাত্রীর কাছ থেকে টিকিট বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে টিকিট সিন্ডিকেট চক্র। সরকার ওমরাযাত্রী ও বিদেশ গমনেচ্ছু যাত্রীদের বিমান ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে দুটি কমিটি গঠনসহ যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ছাড়া অগ্রিম গ্রুপ টিকিট বুকিং-এর কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা জারি করেছে। কিন্তু বিমান ছাড়া বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো সরকারি এ নির্দেশনা তোয়াক্কা করছে না। ফলে যাত্রীর নাম ও পাসপোর্ট নম্বর ছাড়া বুকিং দেওয়া ওমরাযাত্রী ও বিদেশগামী কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে টিকিট বিক্রি অব্যাহত রাখছে। এয়ারলাইন্সগুলো সরকারি জারিকৃত নির্দেশনার সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে পূর্বে বিক্রয়কৃত গ্রুপ টিকিট সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিমানের টিকিট সিন্ডিকেট বন্ধে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো সাড়া দিচ্ছে না। গ্রুপ টিকিট বুকিংয়ের নামে সিন্ডিকেট চক্র আসন্ন রমজানের সকল টিকিট ক্রয় করে চড়া দামে বিক্রি করছে। এতে রমজানের ওমরাহ টিকিট নিয়ে বাজারে চলছে হাহাকার। রমজানে ৮০ হাজার টাকার ওমরাহ টিকিট এখন ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দিকে গড়াচ্ছে যে এসব দেখার কেউ নেই।
আটাবের একটি সূত্র জানায়, বিমানের টিকিট সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে গত ১১ ফেব্রুয়ারি পরিপত্র জারি করে সরকার। এতে ভুয়া নাম, পরিচয় দিয়ে বুকিং করে রাখা টিকিট সাত দিনের মধ্যে যাত্রীর আসল নাম, পাসপোর্ট নম্বর এবং পাসপোর্টের কপিসহ বিক্রি নিশ্চিত করার আদেশ দেওয়া হয়। ৯ দিন পরও পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশ বিমান ও গুটিকতক এয়ারলাইন্সে অল্প কিছু টিকিট অবমুক্ত হলেও বেশিরভাগ এয়ারলাইন্স গা ছাড়া ভাব দেখাচ্ছে। তারা এ পর্যন্ত টিকিট সিন্ডিকেটের কাছে কোনো চিঠি পাঠায়নি বলে জানা গেছে। ফলে সরকারের পরিপত্রের পুরোপুরি সুফল পাচ্ছে না যাত্রীরা। এ পরিস্থিতিতে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) নেতারা সরকারের নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন।
আসন্ন পবিত্র রমজানে ওমরাযাত্রীর চাহিদা ও ফ্লাইট কমিয়ে দেওয়ার সুযোগে সম্প্রতি বিভিন্ন এয়ারলাইন্স টিকিটের দাম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। টিকিট সিন্ডিকেটের সদস্যরা ভুয়া বিমানযাত্রী সাজিয়ে বেশিরভাগ টিকিট গ্রুপ বুকিং দেওয়ায় প্রকৃত এজেন্সি ও বিদেশগামী যাত্রীরা টিকিট পাচ্ছে না। আর এ সংকটের সুযোগ নিয়ে সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিমানের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ।
সাধারণ এজেন্সি মালিকরা জানিয়েছেন, গত নভেম্বর মাসে সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের জেদ্দাগামী টিকিটের দাম ছিল জনপ্রতি ৭৫ হাজার টাকা। ডিসেম্বর পাঁচ হাজার টাকা দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজার টাকা। জানুয়ারি মাসের টিকিট বিক্রি হয় ৮৫ হাজার টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসের টিকিট বিক্রি হয় ৯৫ হাজার টাকা। আর মার্চ মাসের টিকিট পাওয়া যেন দুরূহ। মার্চে রমজান মাস হওয়ায় টিকিটের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১০-২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। সম্প্রতি একটি সভায় বিমানের টিকিট সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে দুটি কমিটি গঠন করে সরকার। টিকিট সিন্ডিকেট শনাক্ত করতে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া ১৩ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি ধর্ম মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন জানান, বিমানের টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণ উদ্ঘাটন করা হয়েছে। নাম, পরিচয় ছাড়াই গুটিকতক ট্রাভেল এজেন্সি সিট বুকিং করে রাখছিল। এতে টিকিটের কৃত্রিম সংকট হওয়ায় দাম দ্বিগুণ থেকে চারগুণ বেড়ে যাচ্ছিল। সরকার এ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এখন থেকে কোনো এজেন্সি বা ব্যক্তি অগ্রিমভাবে টিকিট সংরক্ষণ করতে পারবে না। টিকিট কাটার জন্য সংশ্লিষ্ট যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। টিকিট বুকিং করার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে টিকিট কনফার্ম না করলে এয়ারলাইন্সগুলো টিকিট বাতিল করে দেবে। বর্তমানে যেসব টিকিট অগ্রিম বুকিং করা হয়েছে সেগুলোও সাত দিনের মধ্যে যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে বুকিং কনফার্ম না করলে টিকিট বাতিল করা হবে। ধর্ম উপদেষ্টা আরও বলেন, সিন্ডিকেট ধরতে গঠিত কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া গঠিত টাস্কফোর্স নিয়মিত এয়ারলাইন্স ও সিন্ডিকেটের কার্যক্রম মনিটরিং করবেন। এই নতুন ব্যবস্থার ফলে অতিরিক্ত ভাড়া নির্ধারণ করে সিন্ডিকেট ব্যবসা করার সুযোগ থাকবে না বলেও তিনি জানান। বিষয়টি সব এজেন্সিকে জানিয়ে গত ১১ ফেব্রুয়ারি পরিপত্র জারি করে সরকার। এতে টিকিট বুকিং দেওয়ার তিন দিনের মধ্যে টিকিট ইস্যু করার নিয়ম চালু করা হয়।
এছাড়া ইতোমধ্যে ভুয়া নাম, পরিচয় দিয়ে বুক করে রাখা টিকিট সাত দিনের মধ্যে আসল যাত্রীর তথ্য দিয়ে টিকিট ইস্যু করার আহ্বান জানানো হয়। আকাশপথের যাত্রীসাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণে এয়ার টিকিটের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি রোধকল্পে দেওয়া ১০ দফা নির্দেশনায় আরও বলা হয়, অনতিবিলম্বে গ্রুপ টিকিট বুকিংসহ যেকোনো প্রকার টিকিট বুকিংকালে ভ্রমণেচ্ছু যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও পাসপোর্টের ফটোকপিসহ বুকিং সম্পন্ন করতে হবে। বুকিং প্রদানের তিন দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট যাত্রীর নামে টিকিট ইস্যু না হলে তিন দিন বা ৭২ ঘণ্টা উত্তীর্ণ হবার সাথে সাথে এয়ারলাইন্স স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ওই টিকিট বাতিলকরণ নিশ্চিত করবে। পরিপত্র জারির তারিখ পর্যন্ত এয়ারলাইন্স-ট্রাভেল এজেন্সি কর্তৃক গ্রুপ বুকিং-এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে ব্লক করা টিকিট আগামী সাত দিনের মধ্যে ভ্রমণেচ্ছু যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর ও পাসপোর্টের কপিসহ বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্স এরূপ টিকিট স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বাতিল নিশ্চিত করবে।
এছাড়া টিকিট সিন্ডিকেটের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। একইসাথে সিন্ডিকেটের তৎপরতা বন্ধে ১৩ সদস্যের একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এরপর ৯ দিন পার হলেও বিমান ভাড়া আশানুরূপ কমেনি। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স জেদ্দা, রিয়াদ, মদিনা, দাম্মাম ও কুয়ালালামপুরগামী বিমানের ক্ষেত্রে ভাড়া ২৫ থেকে ১২০ ডলার পর্যন্ত কমিয়েছে। এমিরেটস এয়ারলাইন্স গ্রুপ টিকিট গুলো দ্রুত যাত্রীর নাম, পাসপোর্টসহ কেনা সম্পন্ন করার জন্য এজেন্সির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
এ বিষয়ে সৌদি এয়ারলাইন্সের মার্কেটিং বিভাগের কর্মকর্তা তাহজীব বলেন, এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।
আজ ২০ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার রাতে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ-আটাবের সভাপতি আব্দুস সালাম আরেফ ইনকিলাবকে বলেন, গুটি কয়েক এয়ারলাইন্স সরকারের জারিকৃত পরিপত্রের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের কিছু টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। আর সাউদিয়া এয়ারলাইন্সসহ বেশিরভাগ এয়ারলাইন্স এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তারা চুপচাপ থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে মনে হচ্ছে। তারা হয়তো ১০ দিন সময়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। আজ শুক্রবার দশ দিনের সময় শেষ হবে। কারণ বিগত সময়ে সরকারের এ ধরনের কোনো পদক্ষেপের মুখে পড়েনি। এজন্য সরকারের মনিটরিং দরকার, যাতে তারা সরকারের নির্দেশ মানতে বাধ্য হয়। আমরা চাই ওমরাযাত্রী ও বিদেশগামী কর্মীরা ন্যায্য ভাড়ায় বিদেশ যাক। সরকার পরিপত্র জারি করেছে তা কার্যকর করার দায়িত্বও সরকারের। এর পরেও কোনো কাজ না হলে জাতীয় স্বার্থে আটাব পরবর্তী উদ্যোগ নেবে বলেও আটাব সভাপতি আরেফ উল্লেখ করেন।
আবাবিল হজ গ্রুপের চেয়ারম্যান আলহাজ আবু ইউসুফ আজ বৃহস্পতিবার ইনকিলাবকে জানান, বিমানের সিস্টেমে কোনো ওমরাযাত্রী ও বিদেশগামী কর্মীরা টিকিট পাচ্ছে না। বিমানের টিকিট নিয়ে শুভংকরের ফাঁকি চলছে। চড়া দামেও বিমানের কোনো টিকিট না পাওয়ায় যাত্রীদের মাঝে চলছে হাহাকার। এক প্রশ্নের জবাবে আবু ইউসুফ বলেন, বিমান ন্যাশনাল ক্যারিয়ার। একজন নাগরিক হিসেবে বিমানের টিকিট ক্রয়ের কোনো সুযোগ থাকবে না এবং বিমানের সকল টিকিট কালোবাজারে চড়া দামে বিক্রি হতে তা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি আসন্ন রমজানে ওমরাযাত্রীদের বিমানের টিকিট ক্রয়ের সরাসরি সুযোগ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।ই: প্র:সূ।