
খবর ডেস্ক :
বর্তমান সময়ে অপরাধ জগতে একটি আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। সারা দেশে কিশোর গ্যাং কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এদের তৎপরতা হু হু করে বেড়ে চলেছে। দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য এক মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কিশোররা। বস্তুত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কিশোররা সমাজের নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। আগামী দিনে যারা দেশকে নেতৃত্ব দেবে, তারা যদি এই গ্যাং চর্চা করে বেড়ে ওঠে, তাহলে জাতি একদিন অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।
আজকের শিশু-কিশোররাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের দ্বারা সমাজে কোনো অপরাধ সংঘটিত হোক, তা মোটেই কাম্য নয়। তাই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি স্তরে শিশু-কিশোরদের এমন হীন অপরাধ থেকে বিরত রাখতে হবে। প্রয়োজনে কিশোর অপরাধ রোধে আইনের সংস্কার করতে হবে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের কম কেউ অপরাধ করলে তাকে কিশোর অপরাধী হিসাবে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে কিশোররা যদি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটায়, সেক্ষেত্রে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। শাস্তির মাত্রা লঘু হওয়ার কারণে কিশোররা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। তাই শাস্তির সীমা বাড়াতে আইন বিভাগকে পদক্ষেপ নিতে হবে। উল্লেখ্য, প্রথমে শিশু আইনটি বেঙ্গল চিলড্রেন অ্যাক্ট, ১৯২২ নামে প্রণয়ন করা হয়। এরপর করা হয় দ্য চিলড্রেন অ্যাক্ট ১৯৭৪। পরে এ শিশু আইনটি রহিত করা হয়। সবশেষে সে আইনটিতে কিছু পরিবর্তন এনে শিশু আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। এখানে শিশু আইনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, অনূর্ধ্ব-১৮ বছর পর্যন্ত সব ব্যক্তি শিশু হিসাবে গণ্য হবে। এ আইনে ‘শিশু ও কিশোরে’র প্রভেদ স্পষ্ট নয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত অপরিপক্ব কিশোর হিসাবে গণ্য হতে পারে। উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালের শিশু আইনে ‘চাইল্ড অফেন্ডারে’র জায়গায় ‘ইউথফুল অফেন্ডার’ এবং ‘চাইল্ড কোর্টে’র জায়গায় ‘জুভেনাইল কোর্ট’ বলা হয়েছিল। কিন্তু এ আইনের জটিলতার কারণে কিশোর গ্যাং দমনে একটি প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে। কাজেই এ আইনটি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
কিশোর অপরাধ নিয়ে ১৯৬০ সালে পুলিশের প্রয়োজনে প্রথম গবেষণা করা হয়। এ ধারাবাহিকতায় মোট ৭০টির মতো গবেষণার সন্ধান পাওয়া যায়। এসব গবেষণার ফল নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি দরকার হয় আলাদা কিশোর অপরাধ আইনের। যতদূর জানা যায়, কিশোরদের একত্রিত করে কতিপয় ব্যক্তি তাদের বিভিন্ন ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ত করছে। আবার কোথাও কোথাও কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিশোর গ্যাং তৈরি করছে। বর্তমানে কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডের কারণে প্রতিদিনই দেশজুড়ে চুরি, ডাকাতি, জমিদখল, চাঁদাবাজি, ইভটিজিং, ধর্ষণ, খুন-খারাবি ইত্যাদি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এদের অত্যাচার ও নির্যাতনে সমাজের মানুষ বিষিয়ে উঠছে। ফলে মানুষ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ও অশান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। সমাজের নিরীহ অংশ, বিশেষ করে যাদের কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই বা প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক ও যোগাযোগ নেই, তারাই সবচেয়ে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। তারা তাদের সহায়-সম্পদ ও উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের নিয়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটায়। কখন কারা জায়গা-জমি দখল করতে আসে বা চাঁদা দাবি করে অথবা স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েটিকে বিরক্ত করে-এসব চিন্তায় অভিভাবক মহল সবসময় আতঙ্কের মধ্যে থাকে।
কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি কিশোর-তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার প্রধান কারণ এটি অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের সহজ পন্থা এবং ক্ষমতার হাতছানি। তাই এ ধরনের গ্যাংয়ের সঙ্গে কিশোর-তরুণরা যুক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। টিকটক ও লাইকিসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণেও পথভ্রষ্ট হয়ে কিশোর-তরুণরা এ পথে যুক্ত হচ্ছে। সমাজের উঠতি বয়সের স্কুল ও কলেজগামী কিশোরদের একটি অংশ লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে এ পথে ঝুঁকছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মাদকাসক্তি, দারিদ্র্য, নিুমানের জীবনযাত্রা, পারিবারিক সমস্যা, হতাশা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পর্যাপ্ত শিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবই মূলত কিশোর গ্যাং গড়ে ওঠার পেছনে বেশি দায়ী। এসব ছাড়াও আরও কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। যেমন-শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রভাবে একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে একক পরিবারে পরিণত হচ্ছে। ফলে কিশোররা পারিবারিক অনুশাসনে দীক্ষিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া সামাজিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের অবক্ষয়, দুর্বল কাঠামোর শিক্ষানীতি এবং রাজনৈতিক নীতিহীনতাও কিশোর গ্যাং তৈরির জন্য দায়ী। স্বামী-স্ত্রীর মতানৈক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধাহীনতা, দ্বন্দ্ব-কলহ এবং পরিবারে ভাঙনের ফলে সন্তানরা সহজেই বিপথগামী হয়ে পড়ছে। এছাড়া সন্তানকে যথেষ্ট সময় না দেওয়া, সঙ্গদোষ, যৌক্তিকতা বিচার না করেই সন্তানের সব আবদার সহজে পূরণ করা এবং সন্তান কী করছে সে বিষয় পর্যবেক্ষণের অভাব ইত্যাদি নানা কারণে কিশোর অপরাধপ্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। তাছাড়া পারিপার্শ্বিক পরিবেশের প্রভাবে যেমন-রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা থেকে অনেকের মাঝে হতাশা, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। সেই হতাশা থেকেই ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ হতাশা ও ক্ষোভের কারণে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের অপরাধ ঘটাচ্ছে কিশোররা।
মানুষ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। এর জন্য দায়ী পরিবার ও সমাজব্যবস্থা। এর মধ্যে যদি পারিবারিক শিক্ষার প্রচুর ঘাটতি থাকে এবং সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের জায়গাটা দুর্বল হয়, তাহলে কিশোররা খুব দ্রুত অপরাধের দিকে ধাবিত হয়। আজকের সমাজে তথ্যপ্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব যে কত ভয়ানক হতে পারে তা এখন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে টেলিভিশন, মোবাইল, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন-ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউব ইত্যাদি শিশু-কিশোরদের মারাত্মক রকমের প্রভাবিত করছে। তাই এসব মাধ্যম ব্যবহারে সমাজ-পরিবার যথেষ্ট সচেতন না হলে কোমলমতি শিশু-কিশোররা বিপথগামী হয়ে অপরাধে লিপ্ত হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক।
এক সময় সমাজে মূল্যবোধের চর্চার ঐতিহ্য ছিল। সমাজে মুরব্বিদের সম্মান করার একটি সংস্কৃতি ছিল। পাড়ার বয়স্কদের ছোটরা সম্মান করত। দূর থেকে বড়দের সালাম দেওয়ার প্রবণতা ছিল। অন্যায় করতে দেখলে বড়রা ছোটদের শাসন করত। সেই ঐতিহ্য আজ ভেঙে পড়তে বসেছে। শিশুদের লালন-পালন করার ক্ষেত্রে পরিবারগুলো যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না। এক্ষেত্রে নিুবিত্ত পরিবারের সন্তানরা অপরাধে জড়ায় এমন একটি কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এ ধারণা অনেকটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় সঠিক ও সুষ্ঠু সামাজিকীকরণের বিষয়টি নিশ্চিত করা না হলে কিশোর অপরাধ কমানো সম্ভব নয়। তাছাড়া কিশোরদের রাজনীতির বলয়ের বাইরে নিয়ে আসতে পারলে এসব গ্যাংয়ের শক্তি লোপ পেয়ে এ অপসংস্কৃতির অবসান ঘটবে বলে মনে করি।
পরিবার হলো একটি শিশুর শিক্ষার সূতিকাগার। তাই পারিবারিক অনুশাসন ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় অভিভাবকদের জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। বস্তুত কিশোর অপরাধ দমনে শুধু আইন প্রয়োগই নয়, সামাজিক সচেতনতাও জরুরি। সমাজের মানুষের চিন্তাচেতনায় পরিবর্তন না এলে বা শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার না হলে এ সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। শিশুর সামাজিকীকরণ বা শিক্ষার প্রথম ধাপ হচ্ছে পরিবার। আর এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আঠারো শতকের শেষদিকে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে গ্রোভস পরিবার কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণের জন্য স্যালফোর্ড ল্যাডস ক্লাব নামে একটি ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিল। এভাবে শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিলে এবং উন্নয়নমূলক কাজের দিকে আগ্রহী করে তুলতে পারলে বাংলাদেশেও কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য কমে আসবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কিশোর সংশোধনাগারগুলো কিশোরদের নানাভাবে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া সাইবার সিকিউরিটি ও তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধকল্পে রাষ্ট্রকে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কিশোরদের যাতে কোনোভাবে প্রভাবিত না করতে পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এর পাশাপাশি শহর-গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড শুরু করতে হবে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কিশোরদের মনন ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য গণিত অলিম্পিয়াড, রোবটিকস প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। যেমন-সংগীত, চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, লেখালেখি ও নাটক ইত্যাদিরও প্রায়োগিক অনুশীলন। দেশের সব অভিভাবককে তাদের সন্তানদের বিষয়ে যত্নবান হতে হবে, তাদের চলাফেরার প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে। সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকদের বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে।
পরিশেষে, কিশোর গ্যাং কালচার প্রতিরোধে প্রয়োজন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা। দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, সন্ত্রাসের ভয় ও হুমকি-ধমকি থেকে মানুষকে রেহাই দিতে গণমাধ্যম, রাষ্ট্রের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এবং পুলিশ বাহিনীকে সর্বদা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে নতুন সরকার বিশেষ ব্যবস্থা নেবে, এটাই প্রত্যাশা।
ড. মো. রফিকুল ইসলাম : গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম