অন্তর্বর্তী সরকারের অনেকেই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের প্রতি দুর্বল : কর্নেল অলি

নিজস্ব প্রতিনিধি : লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকান্ডে মনে হয় তাদের অনেকেই ফ্যাসীবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি দুর্বল। অথচ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের আশা-আকাংকা অনেক। তবে এখনও মানুষের মধ্যে এক ধরণের উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা কাজ করছে। কারণ সংস্কার কর্মকান্ডে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। কোন অবস্থাতেই দেশের মানুষকে নিরাশ করা যাবে না। সরকারকে সাহায্য করার জন্য সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে এবং সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। প্রয়োজনে দক্ষ, শিক্ষিত এবং উপযুক্ত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে, উপদেষ্টাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করুন এবং নিয়মিত রাজনীতিতে অভিজ্ঞজনের পরামর্শ নিন। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা এই সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। সংস্কার বাস্তবে রূপ দিতে হবে। এছাড়া প্রত্যেকের মানসিক সংস্কারও প্রয়োজন। গতকাল শনিবার রাজধানীর মগবাজারের এলডিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

কর্নেল অলি আহমদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকান্ডে মনে হয় তাদের অনেকেই ফ্যাসীবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি দুর্বল। অথচ ঐ আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকার গণআন্দোলনের সময় ভয়াবহ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। গত ১৫ বছরে গণতন্ত্রকে নিশ্চিহ্ন ও ফ্যাসীবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন, বিচার ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতি ধ্বংস করেছে। সর্বস্তরে আত্মীকরণ ও দলীয়করণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুন, জনগণের ওপর নির্যাতন-জুলুম, মেগা প্রকল্পের আড়ালে ব্যাপক দুর্নীতি, বিশাল ঋণ নিয়ে লুটপাট, এবং বিদেশে লক্ষ কোটি টাকা পাচার এসব নজিরবিহীন অপরাধ সংঘটিত করেছে। সুতরাং এই দেশে তাদের রাজনীতি করার কোন অধিকার নেই। অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রশ্ন, তাদের নিবন্ধন বাতিল-করার জন্য আরো কত মানুষ শহীদ হওয়ার প্রয়োজন ছিল? আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা যুক্তিযুক্ত। অন্যথায় শহীদদের রক্ত বৃথা যাবে। সময় সীমিত, দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করুন এবং আবেগের পরিবর্তে বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিন।

অলি বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও তাঁর স্বেচ্ছাচারী শাসনে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বারবার নিগৃহীত হয়েছেন। তিনি কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক বা জাতির পিতা হতে পারেন না। তাঁর একনায়কসুলভ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে হাজারও মানুষ খুন এবং গুম হয়েছেন, কিন্তু তবুও তাঁর প্রতি একটি ব্যক্তিপূজার সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছে। এখনও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে শেখ মুজিব এবং তার পরিবারের সদস্যদের নাম বিদ্যমান রয়েছে। এই নামগুলো অবিলম্বে পরিবর্তন করা জরুরি এবং ব্যক্তিপূজার অপসংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেলতে হবে। পাশাপাশি, আমরা আশা করি সরকার বিভিন্ন ধরনের টাকার নোট থেকেও যথাশীঘ্রই শেখ মুজিবের ছবি অপসারণ করবে।

তিনি বলেন, স্বৈরাচারী ও খুনী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়, যে সমস্ত উপদেষ্টা বা কর্মকর্তা গণতন্ত্র হত্যা, মানবাধিকার লংঘন এবং দেশের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য দায়ী, তাদেরকে এখনও পর্যন্ত কেন গ্রেফতার করা হয়নি। এছাড়া হাসিনা সরকারের পতনের পর পরই হযরত শাহ্ জালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে, ইউনিফর্ম পরিহিত কয়েকশ ব্যক্তি দৌড়ে দৌড়ে ভারতের বিশেষ বিমানের মাধ্যমে পালিয়ে যায়। এরা কারা, তা জনগণের জানার অধিকার রয়েছে।

এলডিপি প্রেসিডেন্ট বলেন, দেশে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৮/১০ জন বড় বড় ক্রিমিনাল রয়েছে। যারা একনায়কত্ব কায়েম করার জন্য শেখ হাসিনাকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছে। এই ক্রিমিনালগুলি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেছে বড় বড় প্রকল্পগুলো।এদের মধ্যে অনেকে অনৈতিক কাজেও লিপ্ত ছিল। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দেশের অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছে। রাজনীতিবিদরা তাদের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করেছে। অন্যদিকে তাদের চুরির টাকাও বিদেশে পাচার করে ব্যাংকগুলিকে ঋণগ্রস্ত করেছে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার কয়েকদিন পূর্বেও এই ক্রিমিনাল ব্যবসায়ীরা তাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। এরা দেশদ্রোহী, জনগণের শত্রু এবং মানুষের রক্ত চুষে খেয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে চৌকস অফিসারদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তদন্তের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং শিকড় উপড়ে ফেলতে হবে। বিদেশে পাড়ি দেওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে এবং যারা বিদেশে অবস্থান করছে তাদেরকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় আগামীতেও দুর্নীতি বন্ধ হবে না।

তিনি আরো বলেন, অন্তবর্তীকালীন সরকার অহেতুক সময়ক্ষেপণ করছে। তাদের কর্মকান্ড দেখলে মনে হয়, তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতা ধরে রাখার পরিকল্পনা করছে। কারণ প্রায় দুই মাস সময় অতিক্রান্ত করার পরও এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের আদালতগুলিতে স্বৈরাচারী সরকারের নিয়োগ দেওয়া পি.পি›রা কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও আওয়ামীপন্থী বিচারকগণ নিজ নিজ অবস্থানে বহাল তবিয়তে আছে। ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হচ্ছে। শতকরা প্রায় ৯৫ শতাংশ সরকারি, আধাসরকারি এবং স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে শেখ হাসিনার লোটাবাহিনী এখনও পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দখল করে রেখেছে। ফলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে। সরকারি কর্মকান্ডে স্থবিরতা বিরাজ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত তাদেরকে চিহ্নিত করে, চাকরি থেকে বরখাস্ত করা। বিতর্কিত ব্যক্তিদের পদায়ন করা বন্ধ করতে হবে। যদিও তাদেরকে বরখাস্ত করা দূরে থাক, বরং কিছু কিছু নতুন জায়গায় বিতর্কিত ব্যক্তিদেরকে নতুনভাবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। যেমন- শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি ইত্যাদি।

এলডিপি প্রেসিডেন্ট বলেন, পাহাড়ী এলাকার কিছু কিছু সদস্যরা বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর সদস্যদের সম্মুখে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করতে দেখা যায়। যা কোন অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত পরিবেশের বিষয়টি হালকাভাবে দেখলে সমস্যা বৃদ্ধি পাবে। সমস্যা সৃষ্টিকারীদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। প্রয়োজনে আর্মির সংখ্যা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

তিনি বলেন, স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাইতে বিদেশীদের জন্য একটি শিল্পাঞ্চল বা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় আনলে ঐ অঞ্চলটি খুবই স্পর্শকাতর। কোন একক দেশকে এই অঞ্চলে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া থাকলে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান, বাংলাদেশের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে, এই শিল্পাঞ্চল বা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল জরুরীভিত্তিতে বাতিল করতে হবে।

কর্নেল অলি বলেন, পশ্চিমবঙ্গ এবং দিল্লীর বিভিন্ন সংগঠন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক বক্তব্য অব্যাহত রেখেছে। ভারত কিভাবে আশা করে, এ ধরণের উষ্কানীমূলক বক্তব্য দেওয়ার পরও বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন হবে? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত এই বিষয়গুলি ভারত সরকারের নিকট উত্থাপন করা এবং প্রতিবাদ করা। এছাড়াও ভারত এদেশের বিগত সরকারের বড় বড় দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় দাতার ভূমিকা পালন করছে। আগামীতে আমরাও যদি, তাদের এ ধরণের নাগরিকদের আশ্রয় দিই, তাহলে কি ভাল হবে? তা কি সুপ্রতিবেশী সুলভ আচরণ হবে?

মন্তব্য করুন